• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০১৯, ১০:৫৩ এএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ৫, ২০১৯, ১১:৪২ এএম

সুইডেন আসলামের হাত ধরেই কোটিপতি ইরান

সুইডেন আসলামের হাত ধরেই কোটিপতি ইরান
কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরান- ফাইল ছবি

দুই দশক আগে দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলামের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অপরাধের হোতা হয়ে উঠেন কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরান। গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। আর এ অপরাধ সিন্ডিকেট নিয়ে ফার্মগেট মহাখালী কারওয়ানবাজার ও তেজগাও শিল্পাঞ্চল এলাকায় চাদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ও মার্কেট দখলবাজি করে কোটিপতি বনে যান।
  
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ওরফে ইরানের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সশস্ত্র মহড়া দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয়ভুক্তভোগীরা বলছেন, তিনি এই ওয়ার্ডের ফার্মগেট, খামারবাড়ী, রাজাবাজার ও আশপাশের এলাকার অঘোষিত গডফাদার তার কথাই যেন সেখানে আইন। ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবখানেই চলে ইরান বাহিনীর চাঁদাবাজি। ইরান নিজেও সবসময় চলেন সশস্ত্র ক্যাডার পরিবেষ্টিত হয়ে। ভয়ে এলাকার কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পান না। সম্প্রতি তার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি ও জিকে শামীমের মতো সশস্ত্র ক্যাডারবেষ্টিত অবস্থায় চলাফেরা করেন।তার বহরে প্রায় ২০টি মোটরসাইকেল ও ৮টি গাড়ি রয়েছে। ফিল্মি স্টাইলে একটি পাজেরো থেকে নামেন তিনি।

তবে সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকার এই কাউন্সিলর। 
ইরানের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি  মিরপুর রোডে অবস্থিত ডেভেলপার কোম্পানি মেট্রো হোমসের পান্থপথের একটি প্রকল্পে ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে মেট্রো হোমস লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর জ্যোৎস্না আরা র‌্যাব সদর দপ্তরে একটি অভিযোগও করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, পান্থপথের  ৯১ নম্বর প্লটে একটি বহুতল ভবন নির্মাণকাজ চলার সময় কাউন্সিলর ইরান প্রকল্প থেকে ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। না দেওয়ায় ইরানের সন্ত্রাসী বাহিনী অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়।

ইরান একসময় তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক লীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কলেজ জীবন থেকেই সশস্ত্র ক্যাডার পরিবেষ্টিত হয়ে চলাফেরা করেন ইরান। একসময় এলাকাটি ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম ও তার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সুইডেন আসলামের অবর্তমানে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় ইরান। তার অধীনে বেশ কয়েকজন সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে। তাদের কয়েকজনের হাতে লাইসেন্স করা অস্ত্রও রয়েছে। 
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক এক সভাপতির ছত্রছায়ায় ইরান খামারবাড়ী এলাকার একক নিয়ন্ত্রণ নেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ আশপাশের সরকারি দপ্তরগুলোর ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে ইরানের ক্যাডার বাহিনী। বিভিন্ন ঘুপচি কাজও দিতে হয় তার লোকদের। টেন্ডারবাজির পাশাপাশি ইরান দখল বাণিজ্যেও সিদ্ধহস্ত।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন অভিযোগ করে জানান, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো বাড়ি করতে হলে আগে কাউন্সিলর ইরানকে বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয়। টাকা দিয়ে তার  কাছ থেকে নিস্পত্তি সনদ নিয়ে বাড়ির কাজে হাত দিতে হয়। অন্যথায় বাড়ি তৈরি করা অসম্ভব।

স্থানীয়রা  জানান, ইন্দিরা রোডের মাহবুব প্লাজা ভবনের অনেকটাই দখল করে নিয়েছেন কাউন্সিলর ইরান। এই ভবনের নবমতলায় তার ব্যক্তিগত অফিস। ইরান ও তার ক্যাডার বাহিনী এই ভবনে নিয়মিত আড্ডা দেন। প্রকৃত মালিক অনেক চেষ্টায়ও ভবনটি ফিরে পাননি, অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি। 
স্থানীয় বাসিন্দারা আরও জানান, ইন্দিরা রোডের গ্লোব সেন্টারের কয়েকটি দোকান ইরান তার ক্যাডার চুন্নুর মাধ্যমে দখল করে রেখেছেন। প্রকৃত মালিকরা দোকানগুলো দখলমুক্ত করার জন্য অনেকবার ইরানের কাছে ধরনা দিলেও কোনো লাভ হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, ইরানের শাশুড়ি মনোয়ারা বেগম ২২ ইন্দিরা রোডের বাণিজ্যিক কাম আবাসিক ভবনের মালিক। তিনি কিছু দোকানের পজিশন বিক্রি করে টাকা নিয়েছেন, কিন্তু ইরান ক্ষমতা দেখিয়ে ওইসব দোকান ফের দখলে নিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে এক মুক্তিযোদ্ধার পরিবারও রয়েছে। বিগত সিটি নির্বাচনের মাত্র দুদিন পর ছয় দোকানের মালিককে উচ্ছেদ করে তালা ঝুলিয়ে দেয় ইরানের বাহিনী। পাঁচতলা ওই ভবনের নিচতলায় ভাগ্যকূল মিষ্টান্ন ভান্ডার, মিতা কনফেকশনারি, ডাক্তারের চেম্বার, সেলুন, বইয়ের গোডাউন ও ফার্মেসি ছিল। ওইসব দোকানের সাইনবোর্ড খুলে ফেলা হয়।

জানা গেছে, ফার্মগেটের লেগুনা স্ট্যান্ড থেকে ইরান ও তার ক্যাডার বাহিনীর আয় প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ টাকা।

লেগুনা চালকরা জানান, সম্প্রতি ডিএমপি কমিশনার ঘোষণা দেন ঢাকায় লেগুনা চলবে না। পরে ইরান ওপরে আলোচনা করে লেগুনা চালানোর ব্যবস্থা করে দেন। কারণ এখান থেকে লেগুনাচালকরা দিনে প্রায় ২ লাখ টাকা ইরানকে দেন চাঁদা হিসেবে।

অভিযোগে জানা  যায়, ফার্মগেটের সেজান পয়েন্ট থেকে শুরু করে পুরো ইন্দিরা রোডের ফুটপাতে তিন স্তরে দোকান বসিয়েছে ইরানের লোকজন। সেখানে জামা-জুতা, কসমেটিকস থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার সবই আছে। সিটি করপোরেশনও কখনো সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালায় না। এসব দোকান থেকে দৈনিক ৮০-২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয় ইরানের নামে। লাইনম্যানের মাধ্যমে এসব দোকান থেকে চাঁদা তোলা হয়। ইরানের নাম বলে শ্রমিক লীগ নেতা চুন্নু ও লাইনম্যান আনোয়ার ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করেন। ব্যবসা হোক বা না হোক, ফুটপাত থেকে ইরানকে চাঁদা দিতেই হয়। আল-রাজি হাসপাতাল ও আশপাশের এলাকায় ইরানের নামে চাঁদা আদায় করে লাইনম্যান রিপনসহ ছাত্রলীগ নামধারী কয়েকজন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কয়েকজন আক্ষেপ করে জানান, ইরানের কাছে আওয়ামী লীগের লোকদের কোনো জায়গাই নেই, তিনি শুধু ক্যাডার টাইপের লোকদের মাধ্যমে তার সাম্রাজ্যের রাজত্ব করতে চান। 
প্রধানমন্ত্রীর শুদ্ধি অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে ফার্মগেট, রাজাবাজার, কারওয়ানবাজার, শিল্পাঞ্চল ও মহাখালী ডিওএইচ এস এলাকার ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিক, পরিবহন মালিক, ফুটপাতের হকাররা বলেন, অভিযান শুরুর পর থেকে ইরানের ক্যাডাররা গা ঢাকা দিয়েছে। আকস্মিক চাঁদার জন্য এসে দ্রুত সঠকে পড়ে।

এইচএম/বিএস 
 

আরও পড়ুন