• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০১৯, ০৪:১৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২২, ২০১৯, ০৪:২৩ পিএম

ভারত-পাকিস্তান পরমাণু যুদ্ধ: সম্ভাব্য সঙ্কটের আশঙ্কা ও বাস্তবতা

ভারত-পাকিস্তান পরমাণু যুদ্ধ: সম্ভাব্য সঙ্কটের আশঙ্কা ও বাস্তবতা

সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীর অঞ্চলের বিশেষ অধিকার সংশ্লিষ্ট সংবিধানের বিধি ৩৭০ প্রত্যাহারের ইস্যুতে ভারত বিরোধী মন্তব্যে সরব হয়ে উঠেছে পাকিস্তান। কাশ্মীরিদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের নামে পাকিস্তান- কথিত মুসলিম প্রীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার জোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক মহলেও এ নিয়ে বেশ তোড়জোর চালিয়ে যাচ্ছে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজী।

এরইমধ্যে কাশ্মীর ইস্যুতে একাধিকবার ভারতে সামরিক হামলা চালানোর হুমকি প্রদান করেছে পাকিস্তান সরকার এবং তাদের সেনাবাহিনী। সেই সঙ্গে কাশ্মীর প্রসঙ্গে পাকিস্তানকে সহযোগিতা না করলে সারা বিশ্বকে পারমানবিক হামলার মুখে পড়তে হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারন করেন ইমরান। কিন্তু তারপরেও মধ্যপ্রাচ্যের দু'একটি রাষ্ট্র ছাড়া পাকিস্তানের এই আগ্রাসি মনোভাবের সমর্থন দেয়নি কেউ। এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শুরুতে চীনের সমর্থন পেলেও, চীনা প্রেসিডেন্ট জি শিন পিং্যের সদ্য ভারত সফরের পর এখন তা অনেকটাই শীথিল। এদিকে দেশটির পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে,কাশ্মীরিদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সমর্থনের কথা বললেও যুদ্ধের মত সহিংস কাজে তারা জড়াতে নারাজ।

এদিকে কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে সীমান্তে দু'দেশের সেনাদের মধ্যে লাগাতার সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ সীমান্ত সংঘাতে অন্তত ৭ জন পাকিস্তানি ও ৯ জন ভারতীয় নিহত হন। এছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়েও চলছে কূটনৈতিক লড়াই। পাশাপাশি সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে যার যার অবস্থান থেকে নড়েচড়ে বসে ভারত ও পাকিস্তান। দেশ দুইটি যে রাষ্ট্রব্যবস্থার তদারকি ছেড়ে এই সামরিক দ্বৈরথের দিকে ঝুঁকছে তা এরই মধ্যে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। এখনই এই সংকট সমাধানে না করলে, ত আরো প্রকট হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এই প্রেক্ষাপটে আদৌ ভারত-পাকিস্তান পরমানু যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে কিনা বা সেটি হলে কেমন হতে পারে বৈশ্বিক পরিস্থিতি; তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছেই। বিশেষজ্ঞ মহল ও আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রসঙ্গে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দৈনিক জাগরণের পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।

আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা বিবিসি প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, কাশ্মীর বিরোধের জের ধরে ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক যুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। গবেষকরা বলছেন, এর ফলে জলবায়ুর ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তাতে অনাহারে মারা যাবে আরো বহু কোটি মানুষ। এরকম এক বিপর্যয়ের ধারণা দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর এই দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। আমেরিকার রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এসব আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

সৌজন্যে সিভিসি নিউজ

শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধ কীভাবে শুরু হবে তার কিছু সম্ভাবনার কাল্পনিক দৃশ্যায়নও গবেষকরা তৈরি করেছেন।

দৃশ্য-কল্প ১:

ভারতীয় পার্লামেন্টে বোমা হামলা চালাবে একজন সন্ত্রাসী। নিহত হবেন ভারতীয় নেতারা। জবাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের ভেতরে প্রবেশ করে আক্রমণ চালাবে। নিজেদের রক্ষার্থে পারমানবিক বোমা ব্যবহার করবে পাকিস্তান। এরপর ভারতও তাদের পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করবে। দুটো দেশই তখন তাদের কাছে যতো পরমাণু অস্ত্র আছে সেসব নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হবে।

দৃশ্য-কল্প ২:

কাশ্মীরে আক্রমণ করবে ভারত। তার পর শুরু হয়ে যাবে পারমাণবিক যুদ্ধ। তবে উভয় দেশে যদি বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন নেতারা ক্ষমতায় থাকেন তাহলে হয়তো এরকম কিছু হবে না, এবং একারণেই এখনও পর্যন্ত সেরকম কিছু হয়নি। কিন্তু এরকম আরো নানা রকমের কাল্পনিক দৃশ্য তৈরি করা যায় যার ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

দৃশ্য-কল্প ৩ (সর্বশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায়):

কাশ্মীর সীমান্ত দিয়ে জঙ্গি অনুপ্রবেশের প্রচেষ্টা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে ভারতীয় সেনারা। যা এক পর্যায়ে দু'দেশের সেনাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। এই ইস্যুতে পরস্পর সাংঘর্ষিক হয়ে উঠবে উভয়পক্ষ আর তা এক সময় দেশ দু'টিকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করবে।  

যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. অ্যালান রোবোক, যিনি এই গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন, বিবিসিকে বলেছেন, "ভারত ও পাকিস্তান তাদের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার বাড়িয়ে চলেছে। শুধু সংখ্যার বিচারেই নয়, এসব অস্ত্রের বিস্ফোরণের শক্তিও তারা ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে। ফলে তাদের আশঙ্কা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেই এই যুদ্ধের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।

║ যুদ্ধের দৃশ্যকল্প বাস্তবে পরিণত হবার সম্ভাবনা কতটা:

যুদ্ধের এসব দৃশ্যকল্প কিভাবে তৈরি করা হয়েছে? এসব কী নিছকই কিছু কল্পনা? এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে গবেষক অ্যালান রোবোক বিবিসিকে বলেছেন,কিছু পেশাজীবীকে নিয়ে তারা ওয়ার্কশপ করেছেন যেখানে এসব সম্ভাব্য কারণের কথা উঠে এসেছে।"

ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া কয়েকজন জেনারেলকে আলাদা আলাদা দুটো কক্ষে বসিয়ে দেওয়া হয়। এক পক্ষকে বলা হয় যেসব কারণে যুদ্ধ হতে পারে তার কিছু ধারণা দিতে। তার পর সেগুলো অন্য আরেকটি কক্ষে অপর গ্রুপের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় সেরকম কিছু হলে তারা কী করবেন? এরকম আলোচনার ভিত্তিতেই এসব সিনারিও তৈরি করা হয়েছে।"

তিনি আরও বলেন, "এগুলো কিছু দৃশ্যকল্প। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো কিছু হয় না। নেতারা ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখেন। কিন্তু কখনো কখনো পরিস্থিতি তো নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে! আর সেক্ষেত্রে এমন যেকোনো একটি ইস্যুই পুরো পরিস্থিতিকে চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।"

কতটা সম্ভাবনা রয়েছে ভারত-পাকিস্তান পারমানবিক যুদ্ধের:

আপাতত ভাবে দেশ দুটির মাঝে এমন কোনো কিছু ঘটার যে সম্ভাবনা লোকমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার মূল কারণ, সম্প্রতি কাশ্মীর ইস্যুতে দেয়া পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজীর হুমকি। তবে ভারত যে সে ধরনের কোনো উগ্র মানসিকতা রাখে না তা এরইমধ্যে সেদেশের সরকারের আচরণে সুস্পষ্ট। কারণ একাধিকবার পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হলেও ভারত নিরবে তা পাশ কাটিয়ে গেছে। বিষয়টি অনেক মহল ভারতের দুর্বলতা বলে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করলেও বাস্তবতা কিন্তু তা বলছে না।

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) এক অনুসন্ধানি প্রতিবেদনের তথ্য মতে ২০১৮ সাল নাগাদ পাকিস্তানের সম্ভাব্য পারমানবিক অস্ত্রের মজুদ যেখানে ১৪০-১৫০টি, বিপরীতে

ভারতের কাছে মজুদ রয়েছে ১৩০-১৪০টি পারমানবিক সমরাস্ত্র। অর্থাৎ পরস্পরকে টেক্কা দেয়ার মত যথেষ্ট আনবিক বোমার মজুদ থাকা সত্ত্বেও দেশ দু'টি সে পথে হাঁটার কোনো ইঙ্গিত এখনও পর্যন্ত দেয়নি।

এ প্রসঙ্গে আলোচনায় আনা যেতে পারে কারগিল যুদ্ধের প্রেক্ষাপট। ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মত আণবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালায় ভারত ও পাকিস্তান। তারপর প্রায় ১১ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে কারগিল যুদ্ধের মত একটি ভয়াবহ সংঘাতের অভিজ্ঞতা নিয়েছে পাক-ভারত। কিন্তু সে যুদ্ধে একবারের জন্যেও আণবিক বোমা ব্যবহারের কথা উঠেনি।

বিবিসির তথ্য মতে ভারতীয় সেনা বাহিনীর একজন সাবেক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জি বলছেন, এই গবেষণা একেবারেই কাল্পনিক, যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বিভিন্ন কারণে দেশ দু'টির সীমান্তবর্তী অঞ্চলে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও তা দেশ দু'টির মাঝে পারমানবিক সংঘাতের মত বিধ্বংসী কোনো ঘটনার দিকে গড়াবে না বলেই বিশ্বাস করেন তিনি।

তিনি বলেন,"লোকেরা ভাবছেন দুটো দেশের আণবিক বোমা আছে, তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নয়, তার মানে পাঁচ ছ'বছর পর তাদের মধ্যে পারমানবিক যুদ্ধ বেঁধে যাবে। কোন দেশ ইচ্ছে করে কিছু করতে চায় না। কিন্তু দুর্ঘটনাবশত বিভিন্ন কারণে - যেমন ভয়ে, রাগে অনেক সময় অনেক কিছুই হয়ে যায়।"

এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানি এক বিশেষজ্ঞের মন্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে বার্তা সংস্থা বিবিসি জানিয়েছে যে, ব্যানার্জির এই বক্তব্য এবং এসআইপিআরআই-এর গবেষণার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানের কায়দে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. পারভেজ হুডভাই। তিনি বলেছেন,ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের সম্ভাবনা উত্তেজনাকর একটি পরিস্থিতিতে অবস্থান আছে।

২০১৭ সাল নাগাদ ভারত-পাকিস্তান পারমানবিক অস্ত্রের মজুদের আনুমানিক তথ্য- সৌজন্যে আল জাজিরা

হুডভাই বলেন, "কোন পরিকল্পনা থেকে নয়, বরং দুর্ঘটনাবশতই এরকম যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। দুটো দেশের মধ্যে যদি অনন্তকাল ধরে উত্তেজনা বিরাজ করে, এবং তাদের কাছে পরমাণু অস্ত্র থাকে, তাহলে তো অনেক কিছুই ঘটতে পারে।"

উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "কাশ্মীরের পুলওয়ামার পর বালাকোটে যা হয়েছে, পাকিস্তান ‌এর আরো কঠোর জবাব দিতে পারতো। তখন ভারতও কিছু একটা করতো। এরকম একের পর এক ঘটনায় উত্তেজনা এতোটাই ছড়িয়ে পড়তে পারতো যে পারমাণবিক যুদ্ধও শুরু হয়ে যেতে পারতো।"

"কোল্ড ওয়ার বা শীতল যুদ্ধের সময় যা হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধ তার চাইতেও খারাপ। কারণ, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কয়েক হাজার মাইলের দূরত্ব কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত একই, যেখানে প্রায় প্রতিদিনই একে অপরকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়,ফলে উত্তেজনা শীতল যুদ্ধের চাইতেও বেশি।"

ভারত-পাকিস্তান পারমানবিক সংঘাতে জড়ানোর কারণ কী হতে পারে:

গবেষক অ্যালান রোবোক বলেন, "শুধু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নয়, হতে পারে ভারত ও চীনের মধ্যেও। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে হওয়ারও অনেক কারণ আছে। তবে আমরা ভারত ও পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছি, কারণ কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে এ-দুটো দেশের মধ্যে অব্যাহত বিরোধ চলছেই। সামরিক যুদ্ধে জড়ানোর অতীত ইতিহাসও তাদের রয়েছে।"

তবে পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী মি. হুডভাই মনে করেন, অন্যান্য কারণ থাকলেও কাশ্মীরই হবে প্রধান কারণ। "কাশ্মীরের পরিস্থিতি যতোই শান্ত করা যাবে,পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকিও ততোটা কমে আসবে। দুর্ভাগ্যজনক হলো সেরকম কিছুই হচ্ছে না। এছাড়াও পরিবেশগত কিছু পরিবর্তনও পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে দিতে পারে।"

"পাকিস্তানের বেশিরভাগ পানি আসে হিমালয় থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয়ের সব হিমবাহ গলে উধাও হয়ে গেলে কাশ্মীর পাকিস্তানের জন্যে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে পানির উৎসের জন্যে। এনিয়ে যদি সমঝোতা না হয় তাহলে তো যুদ্ধের আশঙ্কাও বেড়ে যায়।"

অপরদিকে সাবেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ব্যানার্জি বলছেন, সন্ত্রাসবাদের মতো আরো কিছু ইস্যুও যুদ্ধের কারণ হতে পারে। ২০০৮ সালে পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসীরা এসে মুম্বাই-এ আক্রমণ করেছিল। এরকম আক্রমণ আবারও হলে তখন পরিস্থিতি অন্য রকমের হয়ে যেতে পারে। "

তিনি মনে করেন,পানির কারণেও এই যুদ্ধ হতে পারে। "১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তাতে দুটো দেশের কেউই খুশি নয়। যখন উভয়পক্ষ সমান সমান অখুশি হয় তখন মেনে নিতে হয় যে আমি যদি আরো বেশি খুশি হতে চাই তাহলে আমার প্রতিপক্ষ আরো বেশি অখুশি হবে। তখন যুদ্ধের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।"

২০১৯ সাল নাগাদ প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে চালানো এক অনুসন্ধানে সুইডিশ একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসেবে পাকিস্তানের ১৬০টি আর ভারতের আছে ১৫০টির মতো পারমাণবিক বোমা। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা বলছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান ৪০০ থেকে ৫০০ পারমাণবিক অস্ত্র মজুত করে ফেলবে। আল জাজিরা

ইসলামাবাদে কায়দে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু বিজ্ঞানী মি. হুডভাই বলছেন, এই দুটো দেশের মধ্যে পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে।

"যদিও এসব তথ্য অত্যন্ত গোপনীয় তারপরেও ধারণা করা হয় যে পাকিস্তানের কাছে হয়তো দশ/বিশটি বেশি বোমা আছে। ভারতের এখন পারমাণবিক ডুবোজাহাজও আছে। পাকিস্তানও এরকম ডুবোজাহাজ নির্মাণ করছে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এসব অস্ত্র নিক্ষেপের ক্ষমতা ও সংখ্যা দুটো দেশেরই বৃদ্ধি পাচ্ছে।"

এছাড়া অধ্যাপক অ্যালান রোবোক বলছেন,পরমাণু শক্তিধর এসব দেশের যেকোনো দু'টোর মধ্যেই পরমাণু যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার পরমাণু শক্তিধর একটি দেশ এমন আরেকটি দেশে আক্রমণ করতে পারে যাদের পরমাণু অস্ত্র নেই। পরমাণু অস্ত্র যখন আছে তখন পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কাও আছে। ইতোমধ্যেই এরকম একটি যুদ্ধ হয়ে গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, যা থেকে আমরা ভবিষ্যতেও এরকম যুদ্ধের আশঙ্কা করতে পারি।"

তার মত একই মন্তব্য করেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জিও। তিনি বলেন, কোথায় পরমাণু যুদ্ধ শুরু হবে এটা কেউই বলতে পারে না।

ভারত-পাকিস্তান পরমাণু যুদ্ধ হলে কী হবে?

গবেষক অ্যালান রোবোক বলছেন, এর আগেও বেশ কয়েকবার পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তবে তা কখনই বাস্তবে রুপান্তরিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আমি বলতে পারবো না। আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে গত ৭৪ বছরে এই বোমা আর ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্বের অর্থ হচ্ছে এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে। আমরা যদি এসব ব্যবহার না করি,এগুলো ব্যবহারের যদি যৌক্তিক কোন কারণ না থাকে, তাহলে এসব ধ্বংস করে ফেলা উচিত।"

তবে সত্যিই যদি এমন কিছু ঘটে তাহলে সেটি শুধু দেশ দুইটির জন্যই ক্ষতিকর হবে না। বরং একই সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত পরিস্থিতিও উস্কে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞ ধারণা মতে,এমন আণবিক সংঘাতের ফলে ভারত ও পাকিস্তানের অন্তত সাড়ে ১২ কোটি মানুষের তাৎক্ষনিক মৃত্যু

হবে। এছাড়া পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের মারা যাবে আরও কয়েক কোটি মানুষ।

পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে ভারতের নীতি হচ্ছে তারা এই অস্ত্র আগে ব্যবহার করবে না। কিন্তু তারাও এখন এই নীতি পুনর্বিবেচনার কথা বলছে। পাকিস্তান সবসময় বলেছে, এরকম অঙ্গীকার করতে তারা রাজি নয়। ফলে দুটো দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন,এর ফলে পারমাণবিক যুদ্ধ যে কখনোই ঘটবে না,তার কোন গ্যারান্টি নেই।

সবিশেষ উভয় রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে একটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় হয়তো একে অন্যের উপর চাপ বজায় রাখতে নানা সময় পারমাণবিক শক্তি প্রয়োগের হুঙ্কার দিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান,তবে বাস্তবে তা হবার নয়। যতক্ষণ না কোনো একটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রটিকে চরম স্নায়বিক চাপে সহন পরীক্ষায় পরাভূত করতে সক্ষম হচ্ছে। আর সেটি হলে, শুধু ভারত বা পাকিস্তান নয়, পরো বৈশ্বিক পরিস্থিতি প্রকটরূপ ধারন করবে,সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।