• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২০, ১২:০৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৮, ২০২০, ০২:০৬ পিএম

বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক, জরুরি নির্দেশনা জারি

করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ১০৮, আক্রান্ত ৪ সহস্রাধিক

করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ১০৮, আক্রান্ত ৪ সহস্রাধিক

প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস আতঙ্ক। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটি ধীরে ধীরে তার মরণথাবা বিস্তৃত করছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। এরইমধ্যে চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা ১০৮ জনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া এর ভয়াবহতা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে চীনসহ বিশ্বের আরও ১৫টি দেশে।

মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, পর্যন্ত করোনাভাইরাস সংক্রমণে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে পৌঁছেছে ১০৬ জনে। আর ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যাটাও বাড়ছে হু হু করে যা এরইমধ্যে ৪ হাজার ছাড়িয়েছে। সিনহুয়া নিউজ/এনএইচকে নিউজ

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যমের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে জানা যায়, অল্প সময়ের মধ্যেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ চীনের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, নেপাল, মালয়েশিয়ায়। পাশাপাশি এর সংক্রমণ ছড়িয়েছে ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকাতেও। যে গতিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে চীনে, তা সামাল দিতে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে চীনা সরকারকে।

কতটা ভয়ঙ্কর এই করোনাভাইরাস, জেনে নিন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

চীনা বিশেষজ্ঞ গবেষক ও চিকিৎসকরা নিশ্চিতভাবেই দাবি করছেন যে, চীনের উহান শহর থেকেই ছড়িয়েছে এই ভাইরাস। সেখানে চলছে কড়া নজরদারি। সকল বহির্গামী উড়ান, ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। বিশেষ কারণ না থাকলে কাউকে শহর ছাড়তে মানা করা হয়েছে।

উহানে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সেই সংখ্যাটা অন্তত ৪,০০০ হতে পারে বলেই তাদের ধারণা। চীনা সরকারি হিসেব যা বলছে বাস্তবে তার দশ গুণ। চীনের ‘ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন’-এর বিজ্ঞানীরা তেমনটাই মনে করছেন।

থাইল্যান্ডে এই অসুখে চারজন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রে একজন করে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আক্রান্তদের প্রত্যেকেই হয় উহানের বাসিন্দা অথবা সম্প্রতি সেখানে গিয়েছিলেন।

উহান থেকে আসা যাত্রীদের ‘স্ক্রিনিং’ বা পরীক্ষা করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশে। রাশিয়াও পরিচ্ছন্নতা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নজর দিয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করছে, সপ্তাহব্যাপী চীনের চান্দ্র নববর্ষ উদযাপনের সময় বিপুল সংখ্যক মানুষের চীনে আসা বা চীন থেকে বাইরে যাওয়ার কারণে এই অসুখ আরও দ্রুত ছড়াতে পারে।

করোনাভাইরাসটির নাম ২০১৯-এনকভ। সার্স ভাইরাসের মতোই ক্ষমতা এই ভাইরাসের। প্রসঙ্গত, ২০০২-০৩ সালে সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে ৩৪৯ জন ও হংকংয়ের ২৯৯ জন মারা যান। সারা বিশ্বের সব মিলিয়ে ৮০০ জন মারা গিয়েছিলো সার্স ভাইরাসের আক্রমণে।

ভাইরাসটিকে পরীক্ষা করে মনে করা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের উৎস হতে পারে বাদুড় ও সাপ। বেইজিংয়ের ‘চাইনিজ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’ এমনই মনে করছে। যদিও করোনা মহামারীর নেপথ্যে সাপই দায়ী কি-না, নতুন করে সেই প্রশ্ন তুলেছেন একদল গবেষক।

ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট ডেভিড রবার্টসন দাবি করছেন, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিই যে নতুন এই করোনাভাইরাসের বাহক, তার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু সাপ এই ভাইরাসের বাহক, এমন প্রমাণ মেলেনি। ফলে সাপের থেকে মানুষের মধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে, একথা বলার মতো কোনও প্রমাণ নেই। যে কারণে এই পরিস্থিতির জন্য সাপকে দায়ী করা যায় না।

বিখ্যাত সায়েন্টিফিক জার্নাল ‘ন্যাচার’কে এমনটি জানিয়েছেন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক। তবে কোন প্রাণী থেকে নতুন প্রজাতির করোনা মানুষের মধ্যে ছড়াল, তা এখনও অজানাই বলে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন।

রবার্টসনের এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত ইউনিভার্সিটি অব সাও পাওলো’র ভাইরোলজিস্ট এডুয়েরডো ব্র্যানডাও। তার মতে, একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখির মাধ্যমেই নতুন এই করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। তারাই এর বাহক। ফলে সাপকে এই মহামারীর জন্য দায়ী করা যায় না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী করোনাভাইরাস জুনোটিক। অর্থাৎ এই ভাইরাস পশুর দেহ থেকে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। গত ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের একটি সিফুড এবং বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে অজ্ঞাত কোনও প্রাণীর থেকে সেটি ছড়িয়ে পড়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, চীনসহ বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মূল উৎসই হচ্ছে বিষধর চীনা সাপ ক্রেইট এবং কোবরা সাপ।

আক্রান্তদের জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলা ফুলে যাওয়া কিংবা সর্দির মতো উপসর্গ দেখা দিচ্ছে সার্স আক্রান্তদের মতোই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অসুখের প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের নির্দেশিকা সকল হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়েছে, করোনাভাইরাস নামের বৃহত্তর গোত্রের অংশ এই ভাইরাস। সংস্থাটি এর নামকরণ করেছে ২০১৯-এনকভ। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে গলা ব্যথা, কাশি, শ্বাসকষ্ট, সর্দি-হাঁচি, জ্বরসহ সার্স ও মার্সের নানা উপসর্গ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১ থেকে ১৪ দিন সময়ের মধ্যে ভাইরাসটির সংক্রমণ হয়।

চীন ছাড়াও ইতোমধ্যে হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ম্যাকাউ, নেপাল, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, কানাডায় এ ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত করা গেছে। বিগত ১৪ দিনের মধ্যে কেউ যদি এসব দেশে ভ্রমণ করেন তাহলে তাদের জন্য এসব নির্দেশনা বেশি জরুরি।

________________________________________জরুরি ১০ নির্দেশনা__________________________________________

১. যারা এই দেশগুলোর যে কোনো একটিতে ভ্রমণ করেছেন কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাস সম্বন্ধীয় জটিলতা ও উল্লিখিত উপসর্গগুলো যদি কারো শরীরে ধরা পড়ে বা বুঝতে পারেন, তাহলে তাদের অবশ্যই বায়ুবাহিত বিচ্ছিন্নতার মধ্যে রাখতে হবে। এ ধরনের কোনো রোগীকে কোনোভাবেই অন্য কোনো মানুষের সংস্পর্শে আসতে দেয়া যাবে না।

২. যদি আপনার শরীরে সর্দি-কাশি, হাঁচি, ঠান্ডা, শ্বাসকষ্ট অথবা জ্বরের মতো সিভিয়ার অ্যাকুইট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) বা উল্লিখিত কোনো উপসর্গ লক্ষ্য করেন, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া ও আপনার শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা জরুরি। যত দ্রুত সম্ভব এটা করতে হবে।

৩. আপনার মধ্যে যদি এ ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে কোনোভাবেই অন্য কারও সংস্পর্শে যাওয়া যাবে না। এছাড়া আপনার চারপাশের কারও মধ্যে যদি হাঁচি-কাশি, সর্দি কিংবা জ্বর ও শ্বাসকষ্টের মতো এসব লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে তার আশপাশে যাওয়াও আপনার জন্য নিষিদ্ধ।

৪. উপরে যে ১৪টি দেশে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সেসব দেশ ভ্রমণের পর বাড়িতে ফিরে কারও মধ্যে যদি এসব লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে তারা যখন চিকিৎসক কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য হাসপাতাল-ক্লিনিকে যাবেন তখন আপনি অবশ্যই আপনার চিকিৎসককে ভ্রমণের বিস্তারিত জানাতে ভুলবেন না।

৫. যদি কারও মধ্যে ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে আপনাকে অবশ্যই সার্বক্ষণিক মেডিকেল মাস্ক পরে থাকতে হবে। শুধু আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তি নয় এ ভাইরাস যাতে আপনাকে সংক্রমিত করতে না পারে, সেজন্যও আপনার মাস্ক পরে জনসম্মুখে চলাচল করা উচিত।

৬. আপনি যখন মাস্ক ব্যবহার করবেন তখন আপনাকে অবশ্যই এটি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া আপনি যে মাস্কটি পরেছেন তা আপনার মুখ এবং নাক পুরোটা ঢেকে ফেলেছে কিনা এটাও নিশ্চিত করতে হবে। যদি এটা খেয়াল না করেন তাহলে মাস্ক পরে থাকলেও ভাইরাসটি আপনাকে সংক্রমিত করতে পারে।

৭. আপনি যদি একটা মাস্ক প্রতিদিন ব্যবহার করতে চান তাহলে সেটাও হবে ভুল। আপনাকে প্রতিদিন নতুন নতুন মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, যা ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। এছাড়া প্রতিদিন ঘরে ফিরে মাস্কটি খুলে ফেলার পর অবশ্যই আপনার হাত ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে। যাতে করে হাতে কোনো জীবাণু না থাকে।

৮. হাত না পরিষ্কার করে কোনোভাবেই সে হাত দিয়ে অন্য হাত, চোখ, নাক এবং মুখে স্পর্শ করা যাবে না। সাবান কিংবা অন্য যেকোনো জীবাণুনাশক দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ডওয়াশ ব্যবহার করা এক্ষেত্রে উত্তম।

৯. যেসব স্থানে জনসমাগম বেশি সেসব স্থানে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা এ ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। যদি আপনি জনসমাগম বেশি এসব জায়গায় চলাফেরা করেন তাহলে আপনার ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। গেলেও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে সবসময়।

১০. আপনার আশপাশের থাকা কেউ যদি কাশি কিংবা হাঁচি দেয় তাহলে তাদের সংস্পর্শে আসার আগে অবশ্যই আপনার নাক ও মুখ ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে পরিবারের কোনো সদস্যের মধ্যে কারও লক্ষণগুলো দেখা দিলে পরিবারের অন্যদের সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।
 সূত্র: এফপি, রয়টার্স, দ্য ন্যাচার, ইয়াহু নিউজ ও পিটিআই