• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১, ২০২০, ০৩:৫৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১, ২০২০, ০৩:৫৫ পিএম

কোভিড-১৯

কেমন আছেন ইউরোপের কেয়ার হোমের বাসিন্দারা?

কেমন আছেন ইউরোপের কেয়ার হোমের বাসিন্দারা?
প্যারিসের একটি কেয়ার হোমে কফিন নিয়ে আসা হয়েছে। এই হোমে মারা গেছেন ১৬ জন ● রয়টার্স

মৃত্যু হয়তো না-ও দেখা যেতে পারে, কিন্তু কফিন তো আর লুকিয়ে রাখা যায় না।

ফ্রান্সে রাজধানী প্যারিসের একটি কেয়ার হোম, যেখানে সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিরা থাকেন এবং যা বৃদ্ধাশ্রম হিসেবে পরিচিত, তার গেটের বাইরে একটি কফিন ভ্যান থেকে নামানো হচ্ছিল। কফিনটি তখনও প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো।

যারা কফিন ডেলিভারি দিচ্ছিলেন তারা বলছেন, তাদের এই এই সরবরাহ চলছেই, বিরতিহীন।

কেয়ার হোমের গেটগুলো বন্ধ। এখানে এরই মধ্যে ১৬ জন মারা গেছে। সন্দেহ করা হয় তাদের মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসে। আরও ৮০ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

সারা বিশ্বে এই ভাইরাসে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক মানুষ। এ কারণে বৃদ্ধাশ্রমে বা কেয়ার হোমগুলোতে বয়স্ক ব্যক্তিরা কেমন আছেন তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

প্যারিসে যতো কেয়ার হোম আছে তার তিনভাগের একভাগ বৃদ্ধাশ্রমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে।

প্রতিদিন হাসপাতালে কতো মানুষ এই ভাইরাসের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে তার হিসেব সরকারি রেকর্ডে পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু কেয়ার হোমগুলোতে কী পরিস্থিতি সেখানে তার কোনও উল্লেখ নেই।

ডাক্তার আলেকসান্দ্রা সান্নে বলছেন, করোনাভাইরাসে কেয়ার হোমে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ডা. আলেকসান্দ্রা সান্নে বলছেন, কেয়ার হোমে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছে

 

ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলীয় ভোশ এলাকায় আরেকটি কেয়ার হোমে মারা গেছেন কমপক্ষে ২০ জন।

সেখানকার ডা. আলেকসান্দ্রা সান্নে বলছেন, এখানে প্রায় ৫০ জনের জ্বর ছিল, আরI কিছু লোকের নিউমোনিয়া হয়েছিল। ফ্রান্সে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যখন সবচেয়ে বেশি ছিল তখন এখানে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল তাদের শরীরে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে।

মহামারির শুরুর দিকে এসব কেয়ার হোমে অল্প কিছু পরীক্ষা চালানো হচ্ছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল যতোই দিন যাচ্ছে, এসব কেয়ার হোমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ধাই ধাই করে বাড়তে লাগলো।

তারপরই নড়েচড়ে বসলো কর্তৃপক্ষ এবং বৃদ্ধাশ্রমগুলোকে বাইরের দুনিয়া থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কাজ শুরু করলো

ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ইতালি ও স্পেনের। এই দুটো দেশের কেয়ার হোমগুলোতেও এই ভাইরাসের ধাক্কা লেগেছে সবচেয়ে বেশি।

দুটো কারণে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত- এই বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে গণহারে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে আর দ্বিতীয়ত- এসব জায়গায় ডাক্তার ও নার্সেরও অভাব ছিল।

দক্ষিণ স্পেনের একটি নার্সিং হোম।
দক্ষিণ স্পেনের একটি নার্সিং হোম

ইতালির উত্তরাঞ্চলীয় বেরজামোতে কেয়ার হোমে শত শত বয়স্ক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দক্ষিণে এ রকম একটি হোমের স্টাফদের কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার কারণে সেখানকার ৮৩ জন বয়স্ক বাসিন্দাকে না খেয়ে থাকতে হয়েছিল দু’দিন।

স্পেনের কেয়ার হোমগুলোতেও প্রচুর সংখ্যক বৃদ্ধ বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসে। রাজধানী মাদ্রিদের একটি বৃদ্ধাশ্রমে মারা গেছে অন্তত ২০ জন।

এভাবে একের পর এক কেয়ার হোমে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার তড়িঘড়ি করে সেগুলোতে সামরিক ইউনিট পাঠাতে শুরু করে। সারা দেশের ১৩০০ কেন্দ্রে বয়স্ক লোকজনকে জরুরি সহযোগিতা দেয়া ছাড়াও তারা এসব কেন্দ্র জীবাণুমুক্ত করতে শুরু করে।

কোনও কোনও কেয়ার হোমে কর্তৃপক্ষ সঠিক সময়ে পৌঁছাতেও পারেনি। ফলে মাদ্রিদের একটি কেন্দ্রে ২৩ জন বয়স্ক ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন ওই কেয়ারে কাজ করতেন এরকম দু’জন নানও।

বলা হচ্ছে, মার্চের প্রথম দু’সপ্তাহে কেয়ার হোমগুলোতে ১৬০০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং তাদের অর্ধেকেরও বেশি মারা গেছেন কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে।

পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের বিলম্বে বয়স্ক ব্যক্তিদের আত্মীয় স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কেয়ার হোমের কর্মকর্তারাও বলেছেন, কাজ করার মতো তাদের যথেষ্ট কর্মী নেই, নেই ভাইরাসটি থেকে নিজেদের রক্ষা করার মতো পোশাক-আশাকও।

কেয়ার হোমগুলোতে কতো মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বা কতো জনের মৃত্যু হয়েছে তার হিসেব রাখার জন্য ফ্রান্সে একটি বিশেষ অ্যাপ চালু করা করা হচ্ছে।

এসব সংখ্যা পরে মোট মৃত্যুর সংখ্যার সঙ্গে যোগ করা হবে। ফরাসী স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, তখন মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে।

গত কয়েকদিনে কেয়ার হোমগুলোতে কফিনের সরবরাহ বেড়ে গেছে।
কেয়ার হোমগুলোতে কফিনের সরবরাহ বেড়ে গেছে

মার্চ মাসের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ একটি কেয়ার হোম পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সেখানে বয়স্ক লোকজনকে কীভাবে করোনাভাইরাসের কবল থেকে রক্ষা করা যায় তার উপায় নিয়ে আলোচনা করা।

একটি টেবিলের চারপাশে বয়স্ক লোকজনকে নিয়ে তিনি যে বৈঠক করেছেন তার ছবিতে দেখা গেছে যে তাদের মুখে মাস্ক নেই এবং তারা সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে বসেননি।

এর কয়েকদিন পরেই ফ্রান্সের সব কেয়ার হোমে দর্শনার্থীদের যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। আর গত সপ্তাহে বলা হয় যে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে যারা আছেন তারা যেন নিজেদেরকে নিজেদের ঘরেই বন্দী করে রাখেন।

কেয়ার হোমের বাসিন্দাদেরকে মাস্ক সরবরাহ করা হলেও স্টাফদের জন্যে কিছু রাখা হয়নি।

একজন নার্স বলেছেন, কেয়ার হোমগুলোতে ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন।

যখনই কোনও করোনাভাইরাস একটি কেয়ার হোমে প্রবেশ করবে, ধরে নিতে হবে যে সব শেষ মন্তব্য করেছেন একজন নার্স, যিনি তার নাম প্রকাশ করতে চাননি।

আমাদের কিছু করার নেই। এখানে তো যথেষ্ট স্টাফ নেই। ফলে ভাইরাসটি ঢুকে গেলেই প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। 

কেয়ার হোমে বয়স্ক লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট।
কেয়ার হোমে বয়স্ক লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট

প্যারিসের হাসপাতালগুলোর জরুরি ইউনিটে নতুন কোভিড-১৯ রোগীর জন্যে জায়গা নেই। একই সাথে ওষুধেরও অভাব।

ফরাসি স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, তারা এখন ব্যাপক হারে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা চালাবেন। ডাক্তার ও নার্সের মতো ফ্রন্ট-লাইন কর্মীদের জীবন রক্ষার জন্যে লাখ লাখ মাস্ক সরবরাহ করারও আদেশ দেয়া হয়েছে।

ফরাসি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধ মাত্র শুরু হয়েছে। এপ্রিল মাসের প্রথম ভাগ আরও কঠিন হবে।

প্রত্যেক রাতেই ফরাসি নাগরিকরা তাদের বাড়ির জানালা ও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্য-কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা প্রকাশ করছেন।

তারা মনে করছেন, ডাক্তার, নার্স ও কেয়ার হোমের স্টাফ সবাই মিলে একজোট হয়ে এই ভাইরাসকে দ্রুত পরাজিত করা সম্ভব।

তবে জরিপে দেখা গেছে, সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ক্রমশই কমছে। বিবিসি।

এসএমএম