• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২১, ০৮:৪৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২১, ০৮:৪৮ পিএম

গান্ধীর বর্ণবৈষম্য ও ভাস্কর্য ভাঙচুরের ইতিহাস

গান্ধীর বর্ণবৈষম্য ও ভাস্কর্য ভাঙচুরের ইতিহাস

সম্প্রতি মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং ভারতে। ২৭ জানুয়ারি সকালে ক্যালিফোর্নিয়ার ডেভিসের সেন্ট্রাল পার্কের ভাস্কর্যটি উপড়ে ফেলা অবস্থায় উদ্ধার হয়। ৬ ফুট লম্বা ও ২৯৪ কেজি ওজনের গান্ধীর ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যটি গোড়ালি থেকে কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা।

এ ঘটনায় দেশটিতে অবস্থানরত ভারতীয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দোষিদের শাস্তির দাবিতে ও ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনের জন্য বিক্ষোভও হয়েছে অনেক জায়গায়। ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ভারত সরকারও। এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে দায়ী না করলেও খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দায়ী করছেন ভারতীয়রা। তাই গান্ধীর এই ভাস্কর্য ভাঙচুরের মূল কারণ জানতে হলে এর পেছনের অধ্যায়টাও জানা প্রয়োজন।

চার বছর আগে গান্ধীবিরোধী ও ভারতবিরোধী বিক্ষোভের মাঝে ভারত সরকারের উপহার পেয়ে ডেভিস সিটি কাউন্সিল এই ভাস্কর্য স্থাপন করে। অর্গানাইজেশন ফর মাইনরিটি ইন ইন্ডিয়া, ওএফএমআই নামের একটি সংগঠন সেই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেয় এবং ভাস্কর্য স্থাপনে বিরোধিতা করে। ভাস্কর্য স্থাপনের পর থেকেই সংগঠনটি এটি সরানোর দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আসছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া সোসাইটি ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা গৌরাঙ্গ দেশাইয়ের দাবি, বহু বছর ধরেই ওএফএমআই এর মতো ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী খালিস্তানি বিচ্ছিনতাবাদী উগ্রপন্থী সংগঠনগুলো এসব কাণ্ডকীর্তির মাধ্যমে গান্ধীবিরোধী ঘৃণার পরিবেশ সৃষ্টি করে আসছে। বিজনেস অ্যান্ড ফিন্যান্স কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা ইছান কাতির বলেছেন, ভারতীয়-মার্কিনীদের ভয় দেখানোই এই ঘটনার উদ্দেশ্য। গান্ধীর বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ কেবল নিজ দেশেই নয় আফ্রিকাতেও এর সমালোচনা জারি আছে।

যুক্তরাষ্ট্রে গান্ধীর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরেও খালিস্তানি সমর্থকরা ওয়াশিংটন ডিসিতে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে মহাত্মা গান্ধীর একটি ভাস্কর্য ভাঙচুর করে। তবে গান্ধীর ভাস্কর্য বিরোধী প্রতিবাদ আবারও দানা বাধতে থাকে ২০১৬ সালের পর থেকে। আফ্রিকাজুড়ে গান্ধীকে নিয়ে বিতর্কের জেরে ২০১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর একটি ভাস্কর্য সাদা রঙে করে দেওয়া হয়। 

গান্ধীর বর্ণবাদ: 

১৮৯৩ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত প্রায় ২১ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন গান্ধী। আইনজীবী হিসাবে কাজ করার সময় কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যাপারে তিনি বর্ণবাদী মনোভাব পোষণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একদিকে নিজে বর্ণবাদের শিকার হয়ে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ জানান গান্ধী। এর বিরুদ্ধে আন্দোলনও গড়ে তোলেন। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর ইউরোপীয়দের বর্ণবাদ নিয়ে নিশ্চুপ থাকেন তিনি। নিজের এই বিতর্কিত অবস্থানই আফ্রিকানদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারান ভারতের জাতির পিতা।

২০১৬ সালে গান্ধীকে নিয়ে ‘সাউথ আফ্রিকান গান্ধী: স্ট্রেচার বেয়ারার অব এম্পায়ার’ নামের একটি গবেষণা বই প্রকাশ হয়। বইটি প্রকাশের পর আফ্রিকায় গান্ধীর ভূমিকা নিয়ে আবারও বিতর্ক শুরু হয়। আবারও গান্ধীর বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ সামনে আসে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আন্দোলনের মুখে ঘানার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গান্ধীর ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়।

এছাড়া গত বছরের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রে যখন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার নির্যাতনে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষাঙ্গের মৃত্যু হয় তখন থেকেই দেশটিতে ‘ব্ল্যাক লাইভস মেটার’ আন্দোলন চলছে। সারা পৃথিবীতেই এই আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। যার ফলে বর্ণবাদ ইস্যুতে অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের অবস্থানও পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করে গোটা বিশ্ব।

সেসময়ে শ্বেতাঙ্গদের নিপীড়ন, বর্ণবাদ, দাস ব্যবসা আর কৃষ্ণাঙ্গ গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে কলম্বাসের ভাস্কর্য সরানো হয়। এডওয়ার্ড কোলস্টোন ও রবার্ট মিলিগানের ভাস্কর্যেরও একই পরিণতি হয়। যুক্তরাজ্যের লেস্টারে থাকা গান্ধীর একটি ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার আবেদনে ৬,০০০ স্বাক্ষর জমা পড়ে। আবেদনপত্রে গান্ধীকেও একজন “ফ্যাসিবাদী, বর্ণবাদী এবং শিশু যৌন নির্যাতনকারী” হিসেবে বর্ণনা করা হয়। 

দক্ষিণ আফ্রিকায় থেকেও ভারতীয়দের কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে উঁচু জাত হিসেবে গণ্য করতেন গান্ধী এমন অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তাঁর লেখাতেও আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের ‘বর্বর’ ও ‘অসভ্য’ সম্বোধন করা হয়েছে অনেকবার। ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গান্ধী মাস্ট ফল বা গান্ধীর পতন হোক হ্যাশট্যাগেও প্রতিবাদ জানানো হয়। আর তাই ক্যালিফোর্নিয়াতে গান্ধীর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ নয় বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদ আর বিশ্লেষকরা।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, এনডিটিভি ও নিউইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন