• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০১৯, ০২:৫০ পিএম

ব্রেক্সিট ইস্যু : প্রেক্ষাপট থেকে সম্ভাবনা

ব্রেক্সিট ইস্যু : প্রেক্ষাপট থেকে সম্ভাবনা

 

ব্রেক্সিট কি: ব্রেক্সিট হল ব্রিটিশ এক্সিটের সংক্ষেপিত রূপ।  ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তথা অপসারণ বোঝাতে ব্রেক্সিট শব্দটি ব্যবহার করা হয়। শব্দটি অনেকটা গ্রেক্সিটের মতো। গ্রিস ইউরোজোন থেকে ছিটকে পড়তে পারে বলে কয়েক বছর ধরে যে সম্ভাবনার গুঞ্জন চলছিল তা থেকেই গ্রেক্সিট শব্দটি চালু হয়েছিল। সে ধারাবাহিতায় ব্রিটেনের এক্সিট অর্থাৎ ব্রিটেনের ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রশ্নে চালু হয় ব্রেক্সিট শব্দটি।

কিন্তু এ ব্রেক্সিট আসলে কী? কিসের প্রেক্ষিতে এ সারসংক্ষেপের উৎপত্তি? কেন ব্রিটিশ নাগরিকদের কেউ কেউ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়তে চান? কেনইবা আবার সব ব্রিটিশ নাগরিক ইইউ ছাড়তে চান না? এ ব্যাপারে ব্রিটিশ অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মত কী?

ব্রিটেন ১৯৭৩ সালে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটির সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এর লক্ষ্য ছিল সুলভ মূল্যে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য ও অভিন্ন বাজারসুবিধা। ১৯৯৩ সালে ইইউ নিজস্ব মুদ্রা, নীতিমালা, নাগরিকদের জন্য সীমানামুক্ত বিচরণসহ যুক্ত করাসহ অনেকগুলো পরিবর্তন আনে। কিন্তু অনেক ব্রিটিশ নাগরিক ব্রিটেনের ইইউর বিধি-নিষেধ মেনে চলা নিয়ে বেশ নাখোশ।

প্রেক্ষাপট: যুক্তরাজ্যে অভিবাসীদের আধিক্য দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে এ নিয়ে ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে। ইইউ'র নিয়ম অণুযায়ী ইইউভুক্ত ২৮টি দেশের নাগরিক ভিসা ছাড়াই এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রবেশ করার অধিকার রাখে। আর সে কারণে ডেভিড ক্যামেরন সরকার তার প্রথম মেয়াদে ইইউ'র বাইরের দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও ইইউভুক্ত নাগরিকদের প্রবেশ ঠেকাতে পারেনি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্বিতীয় মেয়াদে ইইউভুক্ত দেশের নাগরিকদের যুক্তরাজ্যে প্রবেশ নিরুৎসাহিত করতে চার বছরের জন্য সুবিধা ভাতা বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেন ক্যামেরন। এতে খুশি হতে পারেননি ইইউভুক্ত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। তারা সদস্য দেশের নাগরিকদের সুবিধা ভাতা প্রদানে বৈষম্য করা হলে তা হবে ইইউর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক হবে বলে দাবি তোলেন। আর এ কারণেই যুক্তরাজ্যকে ইইউতে রাখা না রাখার ব্যাপারে প্রশ্ন তৈরি হয়।

ব্রেক্সিট প্রশ্নে ইইউভুক্ত নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে অভিবাসীদের সুবিধা সীমিত করাসহ চারটি সংস্কার প্রস্তাব দেন ক্যামেরন এবং পরবর্তীতে সে প্রস্তাব নিয়ে ক্যামেরনের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছান ইইউ নেতারা। ইইউ’র সঙ্গে সমঝোতার পর দেশে ফিরে ব্রেক্সিটের জন্য গণভোটের তারিখ ঘোষণা করেন ক্যামেরন এবং ২০১৬ সালের ২৩ জুন গণভোটে অণুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেনের ইইউতে থাকা না থাকার প্রশ্নে দেশটির জনগণই ঐ গণভোটে চূড়ান্ত রায় দেন।

২৩ জুন যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকার প্রশ্নে এক গণভোটে নিজেদের রায় জানিয়ে দেয় ব্রিটিশ জনগণ। ওইদিন অনুষ্ঠিত গণভোটেই নির্ধারিত হয় ব্রিটেনের পরিণতি। ভোটের ফল বিপক্ষে যাওয়ায় পদত্যাগ করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।

গণভোট প্রসঙ্গ

ব্রেক্সিট প্রশ্নে ইইউভুক্ত নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে অভিবাসীদের সুবিধা সীমিত করাসহ চারটি সংস্কার প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন। পরে সে প্রস্তাব নিয়ে ক্যামেরনের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছান ইইউ নেতারা। ইইউ’র সঙ্গে সমঝোতার পর দেশে ফিরে গণভোটের তারিখ ঘোষণা করেন ক্যামেরন। ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী, গণভোটের ১৬ সপ্তাহ আগে তারিখ ঘোষণা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসেবে ২৩ জুন তারিখটি নির্ধারণ করা হয়। ব্রিটেনের ইইউতে থাকা না থাকার প্রশ্নে দেশটির জনগণ ওই গণভোটে চূড়ান্ত রায় দেয়।

১৮ কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সী ব্রিটিশ, আইরিশ কিংবা কমনওয়েলথ নাগরিকেরা এ গণভোটে অংশ নেয়। ভোট দেয় ১৫ বছরের কম সময় ধরে বিদেশে থাকা ব্রিটিশ নাগরিকরাও। ইইউতে থাকার পক্ষে ক্যামেরনের উদ্যোগকে ভালোভাবে নেয়নি খোদ রক্ষণশীলদের (কনজারভেটিভ) অনেকে। তবে লেবার পার্টি শুরু থেকেই ইইউ তে থাকার পক্ষে প্রচার চালায়।  লিবারেল ডেমোক্র্যাটস (লিবডেম), এসএনপি এবং গ্রিন পার্টিও চায় যুক্তরাজ্য ইইউতে থাকুক। অপর পক্ষে ইউকেআইপি যুক্তরাজ্যের ইইউতে থাকার ঘোরতর বিরোধী।

ইইউতে যুক্তরাজ্যের থাকার বিপক্ষে ৫২ শতাংশ ও পক্ষে ৪৮ শতাংশ ভোট পড়ে। ইইউতে থাকার পক্ষে লন্ডন ও স্কটল্যান্ড শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। এই দুই অঞ্চলে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট ইউরোপের পক্ষে। তবে ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে ইইউতে থাকার বিপক্ষে ভোট বেশি পড়েছে। এই গণভোটে ব্যাপক হারে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। এমনকি ব্রিটেনের ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এত ভোট পড়েনি। গণভোটে ইইউ এর সাথে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদের রায় পাওয়ার পর একই বছরের ২৪ জুন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন ডেভিড ক্যামেরুন। ক্যামেরুনের পদত্যাগের পর যুক্তরাজ্যের ৭৬তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন তেরেসা মে।  

ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকতে না চাওয়ার কারণ:

ক) ভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থাঃ ইইউয়ের সদস্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য মুদ্রাব্যবস্থা ইউরো ব্রিটেনের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই তারা স্রোতের বিপরীতে অর্থাৎ ইউরোর পরিবর্তে পাউন্ড-স্টার্লিং নিয়েআছে।

খ) স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্তঃ ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষ তাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক (মুদ্রা পাউন্ড-স্টার্লিং,জাতীয় পতাকা ও ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টে প্রণীত আইন)-এর উপর অন্য কারও হস্তক্ষেপ চান না।

গ) জাতীয় ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যঃ ইইউয়ের আইনকানুন সব ক্ষেত্রে ব্রিটেনের সঙ্গে সমগামী নয়। তা ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততার কারণে ব্রিটেন তার জাতীয় ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য হারাতে চায় না।

ঘ) নাগরিক স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধাঃ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের নাগরিকদের স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধাকেই বড় করে দেখে। তারা চায় না ব্রিটিশ নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা কোনোভাবে বিঘ্নিত হোক ।

ঙ) শুধুমাত্র ব্যবসাঃ ব্রিটিশরা ইউরোপীয় সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করতে চায়। তবে এর বেশি কিছু নয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকতে চাওয়ার কারণঃ

ক) রাজনৈতিক দলের দ্বিমতঃ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার ব্যাপারে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা-নেত্রী ও সদস্যরা মোটামুটি একমত এবং না থাকার বিষয়ে রক্ষণশীল দলের নেতা-নেত্রী ও সদস্যরা বিভক্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার ব্যাপারে লন্ডন মহানগরীর নাগরিকরা মোটামুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ বলা চলে।

খ) ইউরোপ বাদ দিয়ে ব্রিটেন নয়ঃ ইউরোপকে বাদ দিয়ে ব্রিটেন নয়। এমনকি যে স্কটল্যান্ড গত বছর ব্রিটেন ত্যাগ করে গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীন হতে চেয়েছিল, তারাও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার পক্ষে নয়

গ) অর্থনৈতিক স্বার্থঃ ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবর্ন সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সম্প্রতি প্রকাশ্যেই বলেন, লন্ডনের শক্তিশালী অর্থনীতি ইইউ ত্যাগ করার ফলে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তা ছাড়া এ নগরীতে চাকরি হারাতে পারে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন:

ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা ইইউ হচ্ছে ২৮টি সদস্য রাষ্ট্রবিশিষ্ট একটি অর্থনৈতিক জোট। কেবল জোটই নয়, বলা চলে এটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের চেয়েও বেশি কিছু। ইইউর জিডিপি ১৮ হাজার বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি। প্রতিষ্ঠার পর গত অর্ধ শতকেরও বেশি সময় ধরে ইইউ স্বাতন্ত্র্য বাড়িয়েছে। আলাদা করে গড়ে উঠেছে ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটিতে যোগ দেয়। পরে এ কমিউনিটিই ইইউ নামে প্রতিষ্ঠা পায়।

ব্রিটেন ইইউ থেকে বের হয়ে গেলে পরবর্তীতে কি হতে পারে:

ইইউ থেকে বের হয়ে গেলে ব্রিটেনের পরিণতি কী হতে পারে তা নিয়ে দুই ধরনের মতামত রয়েছে।  ইইউবিরোধীদের কেউ কেউ বলছেন, এ জোট থেকে বের হয়ে আসলে ব্রিটেনের একক বাজার তৈরি হবে এবং জনগণ অবাধ চলাচলের সুযোগ পাবে। অন্যদিকে বিরোধীরা বলছেন, এ ধরনের ভাবনা অনেক বেশি কাল্পনিক। তাদের মতে, ইইউ থেকে বের হলে ব্রিটেনকে হয় নরওয়ের মতো ইইউ’র বাজেটে অর্থের যোগান দিয়ে যাওয়া এবং জোটের বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করে যেতে হবে কিংবা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধিমালার আওতায় এসে ইইউ’র সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে হবে। ব্রেক্সিটের প্রভাব কী হতে পারে তা দুটো বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। তার একটি হলো, ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্য ইইউ’র সঙ্গে কেমন ধরনের সম্পর্ক রাখতে চায় এবং অন্যটি হলো ইইউ আদৌ সে ধরনের সম্পর্কে রাজি হবে কিনা। তবে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে ইইউ’র সঙ্গে যুক্তরাজ্যের নরওয়ে ধাঁচের সম্পর্ক রাখার সম্ভাবনা কম। সেক্ষেত্রে তাদের মধ্যে দূরবর্তী সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনাই জোরালো হয়ে উঠেছে।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা কী মনে করেন

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বিশ্বাস করেন যে ইইউ থেকে বের হয়ে আসাটা যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির জন্য খারাপ হবে। ১শ জনেরও বেশি প্রভাবশালী চিন্তাবিদের ওপর ফিনান্সিয়্যাল টাইমসের চালানো জরিপে দেখা যায়, ব্রেক্সিট হলে যুক্তরাজ্যের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। জরিপে অংশ নেয়া প্রায় তিন-চতুর্থাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ইইউ থেকে বের হয়ে আসলে বহির্বিশ্বে ব্রিটেনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। মাত্র ৮ শতাংশ মনে করেন, ইইউ থেকে আলাদা হলে ব্রিটেন লাভবান হবে। ২০ শতাংশেরও কম অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, ইইউ ছাড়লে খুব সামান্যই পরিবর্তন ঘটবে।