• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯, ১২:৫৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯, ১২:৫৫ পিএম

ভাঙছে যমুনা, বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম

ভাঙছে যমুনা, বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম

আশ্রাফ আলী শেখ। বয়স ৫৫ বছর। বাড়ি ছিল খোলাবাড়ি গ্রামে। এক সময় ২০ বিঘা ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, সাজানো সংসার ছিল তার। কয়েক দফা নদী ভাঙনের শিকার হয়ে এখন নিঃস্ব। যমুনা সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। বর্তমানে অন্যের বাড়িতে কামলা দিয়ে কোন মতে চলছে জীবন সংসার।
তিনি বলেন, চোক্ষের সুমনে এই আক্ষুসি নদী আমগরে জমি জিরেত কাইর‌্যা নিল। হেরপরেও এহায় দেইনাই, মাতাথুবার ঠাঁই ভিঠেমাডিও খাইলো, তামাতামা কইরে দিছে আমার সংসারডারে। ৬ জন খাওউয়ে নিয়ে মাইনস্যার দহলে ডেরা তুইল্যা থাকছি। ইনুউনু কামলা দিয়ে খাই। এহন হিন্ত বিফদ। একসুম গাইগিরস্ত আছিল বইল্যা কামেও নিবের চায়না। দুহের কতা কি আর কমু ভাই, বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

আশ্রাফ শেখের মতো মজিদ মোল্লা, আবুল মিয়া, আব্দুল মোতালেব, অহেজ উদ্দিন, নুর মোহাম্মদ, গুনু মিয়াসহ অনেকেরই একই জীবনচিত্র।

চিকাজানি-খোলাবাড়ি সড়কের ব্রিজে আশ্রয় নেয়া নদীভাঙা আসমা খাতুন (৬৫) নামে এক বৃদ্ধার সাথে দেখা হয়। স্বামী আবুল হোসেন (৭৫)। ব্রিজের উপরে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বৃদ্ধা। কাজের ফাঁকে তিনি বলেন, ম্যালাবার নদীয়ে ভাইঙে নিছে। শ্যাষম্যাশ ইট্টু ঠাঁই হইছিল্ চর ডাকাতিয়া গুচ্ছ গিরামে। হেইডিও ভাইঙে গেল্ এইবার। আংগরে ঘর তো গেছেই, যিনু থাকছিলেম হেইডিও নদীত চইলে গেছে। খালি চালের টিন আনবার পারছিলেম। এহন বিরিজের উফ্রে সংসার পাতছি। পুলা মাইয়া, নাইনাতি নিয়ে এহানেই আছি গো বাজান। মাইনসের বাড়িত কাজকাম কইরে যা জুঠে তাই খাই।

আসমা খাতুন ছাড়াও মতিউর রহমানের স্ত্রী সুজেদা (২৬), মৃত ছালামের স্ত্রী অবিরন বেওয়া (৬০), জাফর আলীর স্ত্রী কান্দুরি বেগম (৫৫), ভোলা মিয়ার স্ত্রী মরিয়ম (৫৫) ও চাঁন মিয়ার স্ত্রী তসলিমা বেগম (৩০)সহ প্রায় ৫০টি নদীভাঙা পরিবার ব্রিজ ও ব্রিজের আশেপাশে আশ্রিত জীবনযাপন করছেন। এসব আশ্রয়হীন নদীভাঙা পরিবারগুলোর দিন কাটছে অর্ধহারে-অনাহারে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।

জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে যমুনার ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে যমুনা পাড়ের মানুষ। ভাঙন আতংকে সরিয়ে নিচ্ছেন ঘরবাড়ি, দোকানপাট, সহায়-সম্পদ। হুমকির মুখে চিকাজানি ইউনিয়নের খোলাবাড়ি বাজার। ভাঙতে ভাঙতে খোলাবাড়ি বাজারটি রয়েছে যমুনার ৫ হাত দূরে। স্থানীয়রা বলছেন, যে হারে ভাঙছে এভাবে ভাঙতে থাকলে কয়েকদিনের মধ্যেই বাজারটি নদীগর্ভে চলে যাবে। 

গত দেড় মাসের ভাঙনে উপজেলার চিকাজানি ইউনিয়নের নয়াবাড়ি, বড়খাল, চর ডাকাতিয়া গ্রাম, চর মাগুরিয়া প্রায় সম্পূর্ণ ও খোলাবাড়ি গ্রামের অর্ধেক নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এই ৪টি গ্রামের ৫ শতাধিক বাড়িঘর, ফসলিজমি, খোলাবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়, খোলাবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইবতেদায়ী দারুল উলুম মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট ও সরকারি-বেসরকারি নানা স্থাপনা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভাঙনের সাথে প্রতিদিনই বাড়ছে ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা। সর্বনাশী যমুনা কেড়ে নিচ্ছে কারো বসতবাড়ি, কারো ফসলি জমি আবার কখনওবা সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। ছোট হয়ে আসছে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা। তবুও থেমে নেই নদীভাঙা মানুষের জীবন। প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে আছে যমুনাপাড়ের মানুষেরা। 

দেড় মাস ধরে চলছে নদী ভাঙন। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রথম পর্যায়ে ৪৭ লাখ ৪০ হাজার প্রাক্কলিত মূল্যের ১০ হাজার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করে ভাঙন রোধে। এতেও ভাঙন রোধ হয়নি। পুরোটাই যমুনার গর্ভে চলে গেছে বলে স্থানীয়দের দাবি। ৫১ লাখ ৪০ হাজার টাকা টাকা প্রাক্কলিত মূল্যের ১১ হাজার জিওব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে শুরু হয়েছে। এই কাজের উদ্বোধন করেন আবুল কালাম আজাদ এমপি।

স্থানীয়দের অভিযোগ নিয়ে জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাজহারুল ইসলাম বলেন, অনিয়ম হয়নি, ভাঙন আংশিক রোধ হয়েছে। এবার ১১ হাজার জিওব্যাগ ফেলা সম্পন্ন হলে ভাঙনরোধ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভাঙন রোধে জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে। যমুনার ভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধানে দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ থেকে সরিষাবাড়ি পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প পরিকল্পনাধীন রয়েছে। বাঁধটি হলে নদী ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে যমুনাপাড়ের মানুষ।

কেএসটি

আরও পড়ুন