ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার আসামি মাদ্রাসাশিক্ষক আফসার উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে স্থানীয় এলাকাবাসী, ছাত্রছাত্রী ও পরিবারের সদস্যরা।
বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) সকালে সোনাগাজী পৌর শহরের পশ্চিম বাজারে নুসরাতের কবর-সংলগ্ন স্থানে মানববন্ধনে স্থানীয় এলাকাবাসী, কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও আফসারের পরিবারের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধনের ব্যানারে তারা রায়কে ফরমায়েশি রায় উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে সঠিক ও ন্যায়বিচার কামনা করেন।
আফসার উদ্দিনের স্ত্রী সুরাইয়া হোসেন ইফাত কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘নুসরাতের পরিবার ন্যায়বিচার পেলে আমরা কেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হব। নুসরাত হত্যার বিচার আমরাও চাই কিন্তু আমার স্বামীকে অন্যায়ভাবে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। গত ৬ এপ্রিল আমার স্বামী কলেজ রোডে ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ানোর সময় নুসরাত অগ্নিদগ্ধ হয়। কলেজ রোড, জিরো পয়েন্ট, মাদ্রাসা এলাকাসহ পুরো পৌর শহর সোনাগাজী মডেল থানা ও পৌরসভার সিসি ক্যামেরার আওতায় ছিল। ঘটনার পরে গত ১০ এপ্রিল পিবিআই সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে যায়। মামলার বিচার চলাকালীন সময়ে আমাদের আইনজীবী ওই দিনের সিসিটিভি ফুটেজ তলবের জন্য আবেদন করলেও সেটা পাওয়া যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে আমার নির্দোষ স্বামীকে ফাঁসানো হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ হাজির করা হোক। যদি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় আমার স্বামী মাদ্রাসা গেটে পাহারায় ছিল তবে যেকোনো দণ্ড আমরা মাথা পেতে নেব। আদালতে ৮৭ জন সাক্ষীর কেউ আমার স্বামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়নি। নুসরাতের পরিবারে যারা সাক্ষী দিয়েছে তারাও কোনো সাক্ষ্য দেয়নি।’
সুরাইয়া হোসেন ইফাত আরো বলেন, ‘বাদী নোমান আদালতে বলেছে, আমার স্বামীকে ভুল করে আসামি করা হয়েছে। নুসরাতের অডিও ভিডিও জবানবন্দিতে আমার স্বামীর নাম বলেনি। তার পরও আদালত আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। আমরা এ রায় মানি না। প্রধানমন্ত্রী সবার অভিভাবক। আমি মমতাময়ী মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি। উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার না পেলে আমার অবুঝ দুটো সন্তান নিয়ে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’
মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান সানজিদা, সাদিয়া হোসেন, সুমাইয়া আক্তার, সাদিয়া জাহান রোজা, আমজাদ হোসেন সুমন, শাহাদাত হোসেন জুয়েল, হাসান ও নাহিদ বলেন, গত ৬ এপ্রিল নুসরাত যখন অগ্নিদগ্ধ হয়, তখন আফসার স্যার কলেজ রোডে আমাদের প্রাইভেট পড়াচ্ছিলেন। ওই সময় আমরা খবরটি জানতে পারলে স্যার আমাদের ছুটি দিয়ে বাসায় চলে যান। থানার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে তার প্রমাণ মিলবে। সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করে আমাদের স্যারকে ফাঁসানো হয়েছে। ঘটনার সময় স্যার আমাদের সামনে ছিলেন। তিনি ওই সময় গেট পাহারা দেন কীভাবে? আমরা আমাদের নির্দোষ স্যারের মুক্তি চাই। এত দিন প্রশাসনের ভয়ে আমরা মুখ খুলতে সাহস করিনি। এখন নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হওয়াতে আমরা মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছি।
সোনাগাজী সরকারি ছাবের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করে আফসারকে অন্যায়ভাবে ফাঁসানো হয়েছে। নুসরাত যে গ্রামের মেয়ে, আমরাও সে গ্রামের বাসিন্দা। আজকে গ্রামের বহু মানুষ উপস্থিত আছে। আফসার নির্দোষ বলে কেউ তার মৃত্যুদণ্ড মেনে নিতে পারেনি। আমরা চাই নুসরাত হত্যার সঠিক বিচার হোক।’
আফসারের মা বৃদ্ধা নুরজাহান, বোন সেলিনা আক্তার ও সাবিনা আক্তার বলেন, এক মাকে সান্ত্বনা দিয়ে আরেক নিরপরাধ সন্তানের মায়ের বুক খালি কেন। মমতামমী মা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন, সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করে ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করবেন। এ সময় তারা আফসার উদ্দিনকে নির্দোষ দাবি করে অঝোরে কাঁদতে থাকেন।
মানবববন্ধনে বাবার মুক্তি চেয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে হাজির ছিল আফসার উদ্দিনের শিশুসন্তান আরদিনা আফসার আলিফ ও আহনাফ বিন আফসার ওয়াসিম। তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের বাবাকে ফিরিয়ে দেয়ার আবেদন জানায়।
মানববন্ধনে বিপুলসংখ্যক গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর উপস্থিতি ছিল বেশি। বিভিন্ন স্লোগান-সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন হাতে নিয়ে উপস্থিত গ্রামবাসী আফসারকে নির্দোষ বলে তাকে ভালো আখ্যায়িত করে স্লোগান দিতে থাকেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন।
এদিকে মানববন্ধন শুরু হওয়ার আগে সকাল থেকে পৌর শহরের জিরো পয়েন্টে অন্য দিনের তুলনায় পুলিশের উপস্থিতি ছিল বেশি। পৌর এলাকায় পুলিশ টহল দিতে থাকে। ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন শেষে অংশগ্রহণকারীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন।
এনআই