• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০১৯, ০২:০৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১৪, ২০১৯, ০২:১৮ পিএম

গাইবান্ধার এনএইচ মর্ডান উচ্চ বিদ্যালয়ে চলছে প্রাইভেট বাণিজ্য

গাইবান্ধার এনএইচ মর্ডান উচ্চ বিদ্যালয়ে চলছে প্রাইভেট বাণিজ্য
  • না পড়লে পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পাওয়া যায় না
  • স্কুলে নিয়মিত ক্লাস না হওয়ায় প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হচ্ছে হতদরিদ্র শিক্ষার্থী
  • বিষয়ভিত্তিক ৪০০ টাকা নেন একেকজন শিক্ষক

গাইবান্ধা পৌরসভার ব্রিজ রোডের এনএইচ মর্ডান উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শ্রেণী কক্ষে নিয়মিত পাঠদানের পরিবর্তে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ানোয় বাধ্য করছেন। আর এই জন্য হতদরিদ্র পরিবারের এইসব শিক্ষার্থীদের প্রতিমাসে নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে দিতে হচ্ছে বিষয়ভিত্তিক চারশত টাকা।

প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টিতে নিয়মিতভাবে সব বিষয়ের ক্লাস হয় না এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরকে জিম্মি করে শিক্ষকদের কাছে বাধ্যতামূলক প্রাইভেট পড়ানোর দীর্ঘদিনের যে অভিযোগ সরেজমিনে গিয়ে তার সত্যতা পাওয়া গেছে।

দেখা গেছে, নতুন সভাপতি হিসেবে আরিফ হোসেন রিজু যোগদানের পর থেকেই বিদ্যালয়টিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। তার নিরলস প্রচেষ্টায় আরও নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে উন্নত অবকাঠামো ও বেতন কাঠামোর বিপরীতে শিক্ষকদের অনুন্নত মানসিকতার পরিচয় স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছে।

বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের ভবনে রেজাউল নামের এক শিক্ষক প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থীকে গণিত বিষয়ে অংক করতে দিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। বিক্ষিপ্তভাবে ছেলেমেয়েরা ক্লাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরেক শ্রেণি কক্ষে প্রায় ২৫ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন শিক্ষক সজল।
বিদ্যালয়ের পূর্ব পাশের নতুন আরেকটি ভবনে দুই কক্ষে শিক্ষক দুলা মিয়া সরকারি কলেজের ভাড়া করা এক ছাত্রকে নিয়ে ক্লাস ভর্তি ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে দেখা গেছে।

একাধিক অভিযোগ রয়েছে, প্রাইভেট পড়ার অর্থ না থাকা এবং বিদ্যালয়ের গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে সন্তুষ্ট না করায় পরীক্ষার খাতায় কম নাম্বার দিয়ে ফেল করে দিয়ে ফরম ফিলাপ বন্ধ করে দেন শিক্ষক। ফলে থেমে যায় গরিব ঘরের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া। পিছিয়ে যায় পুরো একটি বছর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঝরে পড়ে যায়। তারা আর শিক্ষা জীবনে ফিরে আসে না।

উপস্থিত ৯ম শ্রেণির প্রাইভেট পড়তে আসা শিক্ষার্থী ব্রিজরোডের অমিত এই প্রতিবেদককে অভিযোগ করে বলেন, গতবছর পরীক্ষা ভাল দিলেও শুধু রেজাউল স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে পারিনি বলে ফেল করে দিয়ে ফরম ফিলাপ করতে দেননি। সেসময় আমার সাথে আরও দু'জন ফেল করেছিল, কিন্তু  টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ফরম ফিলাপ করতে দিয়েছিলেন।

পূর্ব কোমরনই গ্রামের রেজাউল মিয়ার মেয়ে ৯ম শ্রেণির ছাত্রী রিক্তা বলেন, স্কুল তো নিয়মিত হয়ই না। ইদানীং সকালে মর্নিং স্কুলে ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টায় আর্টস এবং সায়েন্সের চারটি ক্লাস হয়। ৩০ মিনিটের ক্লাসে কি সবকিছু বোঝা সম্ভব? তাই বাধ্য হয়ে প্রাইভেট পড়তে হয়। 

ব্রিজরোডের ৯ম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী ইমরান জানায়, দুই থেকে ৩টি বিষয়ে পড়ানোর পর বিরতির আগেই ছুটি দিয়ে শিক্ষকরা ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। আবার বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়লে ক্লাসে শিক্ষকরা নানা ধরনের সমস্যাও সৃষ্টি করেন। এতে বাধ্য হয়েই পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করে টাকা নিয়ে স্কুলের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে  হয়।

মিস্ত্রিপাড়ার ৯ম শ্রেণির ছাত্র অমিত জানায়, তাদের নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে না পড়লে পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়া হয়। এতে করে চাইলেও ভালো শিক্ষকের কাছে তারা প্রাইভেট পড়তে পারে না।

খোলাহাটি ইউনিয়নের টিটিসি এলাকার বাসিন্দা ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাকিলের পিতা ফুলমিয়া এবং ১০ম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থীর পিতা ফারুক মিয়া ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের সন্তানেরা সব বিষয়ে ভাল করলেও শুধু এক মার্কের জন্য রেজাউল মাস্টার ফেল করে দেন। অভিভাবক ফারুক বলেন, আমার ছেলের ব্যাপারে রেজাউল মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি গোপনে তাকে দেখা করতে বলেছিলেন। তিনি আরও যোগ করেন, গতকাল বুধবার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নিকট এক নাম্বার কেন কম পেল, তা জানতে খাতা দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে লাম-ছাম বুঝিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। এর আগেও একবার প্রাইভেট না পড়ায় ২৮ জন শিক্ষার্থীকে টেস্ট পরীক্ষায় ওই গণিত এবং ইংরেজিতে ফেল দেখানো হয়েছিল। আর এ কারণেই শিক্ষকদের সন্তুষ্ট রাখতে অভিভাবকরাও এখন বাধ্য হয়ে স্কুলের শিক্ষকের কাছেই প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। টাকা থাক কিংবা না থাক।

বিদ্যালয়টির ইংরেজি, অংক ও বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক এ প্রাইভেট কিংবা কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সরকারি উন্নত বেতনভাতা থাকা সত্ত্বেও দায়িত্বে অবহেলা, ইচ্ছে মত বিদ্যালয়ে আসা, পরীক্ষার প্রশ্ন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনৈতিক মুনাফা অর্জনে সদা ব্যস্ত থাকে এই বিদ্যালয়ের মুনাফালোভী শিক্ষকরা।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, শিক্ষকদেরকে অনেকবার প্রাইভেট না পড়ানোর জন্য বলেছি। শুধু টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানকে প্রাইভেট সেন্টারে পরিণত করা সম্পূর্ণ অনৈতিক। এ ব্যাপারে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তবে এ বিষয়ে শিক্ষক রেজাউল এবং দুলা মিয়া উভয়ের কাছে নিজ বিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষে ক্লাস না করিয়ে টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তারা কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে কাজটি যে অনৈতিক এবং শিক্ষা পরিপন্থী তা অবলীলায় স্বীকার করেছেন।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আরিফ হোসেন রিজু বলেন, অভিভাবক খাতা দেখতে চাইলে অবশ্যই দেখাতে হবে। প্রাইভেট বাণিজ্যের বিষয়টি অত্যন্ত নিন্দনীয়। এ বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন জাগরণকে বলেন, নিয়মিত ক্লাস না হওয়া এবং নিজ বিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন শিক্ষকরা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কোচিং বন্ধের মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক উত্তম কুমার রায় জাগরণকে বলেন, কোচিং বা প্রাইভেট টিউশন বন্ধের ব্যাপারে আমরা অভিযান শুরু করেছি। এ ধরনের শিক্ষকদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে বলে তিনি জানান।

কেএসটি

আরও পড়ুন