• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০২০, ০৪:৩২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২, ২০২০, ০৫:৪২ পিএম

করোনায় চলছে জলবায়ু মেরামত

অবরুদ্ধ সভ্যতা, অবমুক্ত আদিমতায় উদ্ভাসিত পৃথিবী

অবরুদ্ধ সভ্যতা, অবমুক্ত আদিমতায় উদ্ভাসিত পৃথিবী

জেনেটিক্স বায়ো উইপনারি হোক বা অস্তিত্ব রক্ষায় প্রকৃতির পাল্টা মারণাঘাত; মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে সারা বিশ্বের মানব সম্প্রদায় যখন বিপর্যস্ত তখন নিজেকে সারিয়ে তোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী নামক বিশেষ গ্রহটি।

করোনার জেরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন অবরুদ্ধ কয়েক কোটি মানুষ, ঠিক তখন উন্মুক্ত বিশ্ব চরাচর পরিণত হয়েছে প্রাণিকূলের প্রমোদ্যাণে। বিষ্ময়করভাবে ক্ষতি পুষিয়ে আনছে ওজোন স্তর, দূষণ মুক্তির উদযাপনে মেতেছে জলবায়ু। ওজন লেয়ারের স্ট্র‍্যাটস ও মনোজফিয়ার স্তরে ঘটছে বায়োপার্টিকলসের পুনর্বিন্যাস, ঘটছে সূর্যের বেগুনি রশ্মি প্রতিহতে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক বর্মের মেরামত। এমনটাই দাবি করছেন পরিবেশ ও জলবায়ু বিজ্ঞানীরা এবং ন্যাচারাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গবেষকরা।

সংস্থার এক গবেষণামূলক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে কমে এসেছে ব্যস্ত বৈশ্বিক জীবন ব্যবস্থার চলমান প্রক্রিয়া। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে নিজ নিজ ঘরে অবরুদ্ধ হয়ে আছে রাষ্ট্রগুলো। কল-কারখানা, পারমাণবিক গবেষণা, বিধ্বংসী সমরাস্ত্রের প্রয়োগের মতো অতি ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলো হ্রাস পেয়েছে ব্যাপক। যানবাহনের ব্যবহার কমে যাওয়ায় জলবায়ুতে সিসার পরিমাণও কমে এসেছে। বাড়ছে অক্সিজেন ভ্যান্টিলেশন সিস্টেমের সক্রিয়তা। একই সঙ্গে জলবায়ুতে ক্ষতিকর কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিসরণও হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে রীতিমত বন্ধই হয়ে গেছে বৃক্ষনিধন, বনজ সম্পদ আহরণ, মাইনিং ও সয়েল টেম্পারিংয়ের মতো প্রাকৃতিক উপাদান বিনষ্টের হারও।

এ প্রসঙ্গে একদল গবেষক বলছেন, কপ২৫-এর মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সুরক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোও যখন ব্যর্থ হয়েছে পৃথিবীর মানুষগুলোকে বোঝাতে। তখন যেন প্রকৃতি নিজেই নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া হয়ে পাল্টা আঘাত হেনেছে দখলদারদের বিরুদ্ধে। কারণ স্বার্থপর মানুষ শুধু নিজের আজ নিয়ে ভাবলেও পৃথিবী বাধ্য হয়েছে তার আগামী প্রজন্মের কথা ভাবতে। আর তাই নতুন প্রজন্মের জন্য নিজেকে বাসযোগ্য করে রাখতেই তার এই বিপ্লব।

বিশ্বজুড়ে চলছে লকডাউন। গাড়ি চলাচল করছে না। বন্ধ কল-কারখানা। ফলে এক ধাক্কায় অনেকটাই কমেছে বায়ু দূষণের মাত্রা।

বিজ্ঞানীদের দাবি, তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে পরিবেশ ও ওজোন স্তরেও। সম্প্রতি একটি গবেষণায় এমনই তথ্য উঠে আসছে। ওজোন স্তরের ক্ষত সম্পূর্ণভাবে নিরাময় হয়ে যাচ্ছে।

দূষণের ক্ষত সারিয়ে ক্রমশ স্বাভাবিক হচ্চে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর।

কলোরাডো বোল্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিআইআরইএস এর এক পর্যবেক্ষক এই বিষয়ে জানায়, দক্ষিণ গোলার্ধে পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়ার পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে।

কলোরাডো বোল্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানাচ্ছেন, বায়ু দূষণের ফলে ওজোন স্তরে যে গহ্বরের সৃষ্টি হয়েছিল তা ধীরে ধীরে মেরামত হচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর পরিবেশ ও জীব জগত বড়সড় বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে। দূষণ কমছে, ধীরে ধীরে সজীব হচ্ছে পৃথিবী। একই সঙ্গে দূষণের ক্ষত সারিয়ে ধীরে ধীরে ‘সুস্থ’ হয় উঠছে বায়ু মণ্ডলের ওজোন স্তরও।

ন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড ন্যাচারের বিশেষজ্ঞদের মতে, সূর্য থেকে আসা আলোর ফলে পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার হয়। তবে এই আলোর সঙ্গে সেখান থেকে অতি বেগুনি রশ্মিসহ আরও অনেক ক্ষতিকর আলোক রশ্মিও চলে আসে, যা পৃথিবীতে থাকা বিভিন্ন প্রাণির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তবে এই ক্ষতিকর আলোক রশ্মিগুলোকে শোষণ করে নেয় ওজোন স্তর, এছাড়া শুষে নেয় কার্বন-ডাই-অক্সাইডও। এর মাধ্যমে পৃথিবীকে ও পৃথিবীর সব প্রাণকে রক্ষা করে এটি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণ ও ক্ষতিকর সিএফসি গ্যাসের ব্যবহারের ফলে ক্রমেই ক্ষয় হচ্ছিলো এই স্তরটি, যার ফলে পৃথিবীতে প্রবেশ করছিলো ক্ষতিকর সব রশ্মি, বাড়ছিলো কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণও।

এর ফলশ্রুতিতে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছিলো। যার অন্যতম ভয়াবহ একটি ধারাবাহিক ধাক্কা বেশ ভুগিয়েছে গোটা ২০১৯ সাল জুড়ে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে সেরে উঠছে ওজোন স্তরের সেই ক্ষত। ওজোন স্তর ও বিশ্বের পরিবেশ নিয়ে এই সমীক্ষাটি পরিচালনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরোডা বিশ্ব বিদ্যালয়ের একদল গবেষক, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন অন্তরা ব্যানার্জি।

গবেষণাটিতে দাবি করা হয়েছে, ওজোন স্তরকে রক্ষায় ১৯৮৭ সালে স্বাক্ষরিত মন্ট্রিয়াল চুক্তির সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি যোগ হওয়ায় বহু বছর ধরে এর যে ক্ষতি হয়ে আসছিলো, তা পুষিয়ে যাচ্ছে। আর মাত্র তিন মাসে সে ক্ষত ভরে এসেছে অনেকটাই। এই ধরনের পদক্ষেপ যদি আমরা গ্রিনহাউস গ্যাস নিসরণের ক্ষেত্রেও নেই, তবে পৃথিবী অনেকটাই দূষণ মুক্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু মানুষ যখন তার নিত্য সঙ্গী এই প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থে শুধু রক্ষা করে যায় আর তার ভরণপোষণে দেয় চরম অবহেলা, প্রকৃতি তখন অস্তিত্বের দায়ে বাধ্যগত প্রাণঘাতী সংঘাতে জড়ায় মানুষের বিরুদ্ধে।

সুদীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর বুকে কর্তৃত্ব করছে প্রাণিজগতের সবচেয়ে মেধাসম্পন্ন ও ক্ষমতাসীন সদস্য, মানুষ। এক সময় যে পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়িয়েছে প্রকাণ্ড ডাইনোসর আর প্রাগৈতিহাসিক মেমথ বা হিংস্র সেবিয়াররা; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সবাইকে পরাস্ত করে পৃথিবীর বুকে নিজের রাজত্ব কায়েম করেছে মানুষ।

অফুরন্ত সম্পদ আর জীবনের জন্য সঞ্চিত হাজারো উপাদানের আধার এই পৃথিবীকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করে তার গলায় দাসত্বের শৃঙ্খল পড়িয়ে দিয়েছে মানুষ। বন্ধু তো দূর শাসকও নয় বরং আগ্রাসি শোষকের মত কালে কালে খুবলে নিয়েছে প্রকৃতিকে, বিনিময়ে ধ্বংস, পতন আর বিপর্যয়ই শুধু দিয়েছে। সেই প্রকৃতি আজ যেন জানান দিচ্ছে, চাইলে চোখের পলকেই সে থমকে দিতে পারে মানুষের ঔদ্ধত্য। বন্ধ করে দিতে পারে মানুষের পদচারণা। আর তারই প্রত্যক্ষ উদাহরণ আজকের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট। আজ সারা পৃথিবীর মুক্ত প্রাণিকূলের সামনে অবরুদ্ধ মানব সমাজ যেন এক আজব চিড়িয়াখানা।

লেখক ● নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

সম্পাদনা- এস এম সাব্বির খান