• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০১৮, ০১:৩৫ পিএম

ভবিষ্যতে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে: ম তামিম

ভবিষ্যতে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে: ম তামিম
প্রফেসর ড. ম তামিম


প্রফেসর ড. ম তামিম সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা এবং বুয়েটের ডিপার্টমেন্ট অব প্রেট্রোলিয়াম এন্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক। তিনি তেল ও জ্বালানী তেলের আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অতীত, ভবিষ্যত নিয়ে জাগরণকে সাক্ষাতকার দেন। সাক্ষাতকারটি দৈনিক জাগরণের পক্ষে গ্রহণ করেছেন এম এ খালেক।

জাগরণ : আন্তর্র্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। হঠাৎ করে এভাবে জ্বালানি তেলে মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন?

প্রফেসর ড. ম তামিম: আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির যে প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছি তা হঠাৎ করে ঘটছে না। আমরা জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির আলামত আমরা গত ৬ মাস ধরেই দেখতে পাচ্ছি। এটা হয়েছে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরানের উপর জ্বালানি তেল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা (এমবার্গো) জারির ফলে। ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি ইরানের জ্বালানি তেল আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

জাগরণ: এর ফলে ভবিষ্যতে জ্বালানি তেলের মূল্য কি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে বলে মনে করেন?

ম তামিম: ভবিষ্যতে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে। তবে এটা নির্ভর করবে ইরান তার জ্বালানি তেল আদৌ বিক্রি করতে পারে কিনা তার উপর। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি,ভারত ঘোষণা করেছে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মানবে না। তারা ইরান থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করবে। ভারতের প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। তারা ইরান থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল আমদানি করবে। ভারতের স্থানীয় মুদ্রা রুপির বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্য অনেক বেড়েছে। ভারতের এই ঘোষণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভরকে গেছে। কারণ মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে কোনো ধরনের বিরোধে যেতে চায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরান থেকে জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ভারতকে ছাড় দিবে কিনা সেটা চিন্তা-ভাবনা করছে। ইস্যুটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ৮৪/৮৫ মার্কিন ডলারে চলে গেছে। এ বছর শেষের দিকে গিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ৯০/৯৫ মার্কিন ডলারে উন্নীত হতে পারে। এই যে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা বা আশঙ্কা এটা আমরা আগে কল্পনা করি নি। কারণ এই সময় ট্রাম্প কোনো ফ্যাক্টর নয়। আমরা যদি গত বছর বা তার আগের বছরের আইএমএফ,বিশ্বব্যাংক বা মর্গান এদের প্রক্ষেপন দেখি তাহলে দেখবো তারা প্রক্ষেপন (প্রেডিকশন) করেছিল যে, আগামী ৫ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ৬০ বা সর্বোচ্চ ৬৫ মার্কিন ডলার থাকতে পারে। জ্বালানি তেলের চাহিদা এবং সরবরাহ কিন্তু সেটাই নির্দেশ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের সরবরাহ অনেক বেড়ে গেছে। ইরানের ঘটনা এবং লিবিয়া এবং ইরাকেও জ্বালানি তেল উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে। মূলত এসব কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।


জাগরণ : এই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে ওপেকের কি ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে করেন?

ম তামিম: আমি মনে করি,আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে ওপেকের খুব একটা ভূমিকা নেই। যদিও জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক মূল্য বৃদ্ধির জন্য ট্রাম্প প্রশাসন ওপেকের উপর দোষারোপ করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ওপেক এই অভিযোগ অস্বীকার করছে। তারা বলছে,ওপেকের কোনো ভূমিকা নেই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে। সৌদি আরব যদিও বলেছে,ইরানের উপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের সরবরাহের ক্ষেত্রে যে ঘাটতি হবে তা তারা উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মেটাতে পারবে। যেহেতু ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দিতা আছে। অন্য দিকে ইরান বলেছে,সৌদি আরব চাইলেই এটা করতে পারবে না। আমার ব্যক্তিগত ধারনা সৌদি আরব এটা পারবে না। কারণ সৌদি আরবের জ্বালানি তেল উৎপাদন ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসছে। তাই তারা চাইলেই ব্যাপকভাবে তেলের উৎপাদন বাড়াতে পারবে না। এক সময় সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই চেয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্য কম থাকুক। তারা মূলত দু’টি কারণে এমনটি চেয়েছে। যদিও তারা রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি তেলের মূল্য কম থাকুক এটা চেয়েছে মূলত রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা আয় কম থাকুক এ কারণে। কারণ রাশিয়া বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেল রফতানির ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভালো অবস্থানে রয়েছে। সম্ভবত তারা দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল রফতানিকারক দেশ। কাজেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কম থাকলে রাশিয়ার রাজস্ব আয় কম হবে। রাশিয়া এ কারণে বেশ দুর্ভোগ পোহিয়েছে। একই সময়ে ইরানও যাতে অতিরিক্ত হারে জ্বালানি তেল রফতানি করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করাও এর উদ্দেশ্য ছিল। কারণ ৬ জাতি নিউক্লিয়ার চুক্তির মাধ্যমে আবার জ্বালানি তেল রফতানি শুরু করে। তখন সৌদি আরব ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে রাখার জন্য জ্বালানি তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কম রেখেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সৌদি আরবের অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসার কারণে তারা জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হয়।

জাগরণ: আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের নিয়ন্ত্রণে ওপেক কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন?

ম তামিম: আগে ওপেক জ্বালানি তেলের উৎপাদন এবং সরবরাহ হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতো। এখন ওপেকের সেই ভূমিকা কার্যত নেই। কারণ ওপেকের বাইরে রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেল সবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। কাজেই ওপেকের সেই আগের ক্ষমতা এখন আর নেই। এ ছাড়া ওপেকভুক্ত অনেক দেশেরই জ্বালানি তেল উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে। কাজেই তারা চাইলেই বিশ্ব বাজার আগের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

জাগরণ: অনেকই বলে থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেলের মজুদ গড়ে তুলেছে। এটা কি সেই ’৭০ এর দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে করা হয়েছে?

ম তামিম: না,আমি সেটা মনে করি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেটা করেছে তা পুরোপুরি তাদের অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকেই করেছে। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার জন্যই তারা এমন মজুদ গড়ে তুলেছে। এখনতো তারা জ্বালানি তেল রফতানিও করতে দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি তেলের পাশাপাশি এলএনজি আকারে গ্যাসও রপ্তানি করতে দিচ্ছে।

জাগরণ: অনেকেই এমনটি বলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী ৫০/৬০ বছরের জ্বালানি তেলের মজুদ গড়ে তুলেছে। এটা কি ঠিক?

ম তামিম: এটা অনেকেই বলেন। কিন্তু আমাদের নিকট যে তথ্য আছে তা এটা সমর্থন করে না। নতুন টেকনোলজির কারণে বিশেষকরে শেল ওয়েল বাজারে আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তেল উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। শেল ওয়েল অনেক নুতন একটি টেকনোলজি। এটা দিয়ে ভবিষ্যতে তারা জ্বালানি তেল উৎপাদন করতে পারবে এমন ধারনা আগে ছিল না। কাজেই বলা যাবে যে তারা জ্বালানি তেলের মজুদ করে রেখেছিল এখন সেটা উৎপাদন করছে। আমি মনে করি, এটা এক ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হতে পারে।

জাগরণ: বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নিরাপদ জ্বালানি তেলের মজুদ গড়ে তোলার জন্য কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে?

ম তামিম: আমরা অনেক আগেই এমন আশঙ্কা করছিলাম। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন যেহেতু জ্বালানি তেল নির্ভর হয়ে গেছে। ৩৬ শতাংশ বিদ্যুৎ এখন জ্বালানি তেল ব্যবহার করে উৎপাদন করা হচ্ছে। ৬১ শতাংশ বিদ্যুৎ গ্যাস থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। আমরা ৫ বছর সময় পেয়েছি কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেল নির্ভরতা কমাতে পারিনি। আমরা কয়লা বা এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারতাম। যদিও এলএনজি কয়লার তুলনায় ব্যয়বহুল হলেও জ্বালানি তেলের চেয়ে এর খরচ কম। উপরন্তু এটা পরিবেশ বান্ধব। এ ব্যাপারে আমরা অনেক বারই বলেছি। কিন্তু সরকার সঙ্কট মোকাবেলার জন্য তেল নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছে। বিদ্যুতের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। বিদ্যুৎ নেই বা সরকার কাঙ্খিত মাত্রায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। লোড শেডিং করতে হচ্ছে সেটা রাজনৈতিকভাবে সরকারের নিকট অনেক বেশি মূল্যবান। কাজেই সরকার বেশি মূল্যের তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে হলে এই সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টা করছে। তেল এবং বিদ্যুতের এই যে কারবার তা সম্পূর্ণ রূপেই রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে করা। অর্থনৈতিক দিকটি এখানে উপেক্ষিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে যদি এটা করা হতো তাহলে বিদ্যুতের মূল্য আরো বৃদ্ধি পেতো। তেলের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারিত হতো।

জাগরণ: বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতি বছর যে লোকসান  দেয় তা কিভাবে বন্ধ করা যেতে পারে?       
 
ম তামিম: গত চার বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য যখন কম ছিল তখন তারা প্রচুর মানুফা করেছে। বাংলাদেশে যতগুলো করপোরেশন আছে তার মধ্যে বিপিসি হচ্ছে সবচেয়ে অস্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান (নন ট্রান্সপেরেন্ট অর্গানাইজেশন)। এমন কি আইএমএফ শর্ত দিয়েছে যে,আন্তর্জাতিক এ্যাকাউন্টিং দিয়ে বিপিসি’র একাউন্টিং ঠিক করতে হবে। সরকার বিষয়টি ধোয়াশার মধ্যে রাখে। বিপিসি তো কিছু বলেই না। আমাদের ধারনা বিপিসি এই ক’বছরে কম করে হলেও ৩০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এর বেশিও হতে পারে। যেহেতু এখন বিপিসি’র টাকা লাগছে তাই সরকার এ ক্ষেত্রে কিছু ভর্তুকি দিতে পারে। আর বিপিসি’কে এখন তার জমানো টাকা থেকে ভর্তুকি দিতে হবে। কারণ এই সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া। যদি অর্থনৈতিক বিচেনায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপিসি’র তেলের মূল্যও বৃদ্ধি করা হতো।

জাগরণ: আগামীতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য আরো বৃদ্ধি পেলে কোন্ কোন্ খাতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে বলে মনে করেন?

ম তামিম: জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়বে। তবে প্রথমেই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেল উভয়ের মূল্য বৃদ্ধি পেলে আমাদের আমদানি নির্ভরতা বেড়ে যাবে। আমাদের গ্যাসের সরবরাহ কম। সেটাও আমরা আমদানি করছি। আমদানি নির্ভরতা আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তাকে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। সরকারের বর্তমান পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি জ্বালানি আমরা আমদানি করবো। আমাদের নিজস্ব জ্বালানি গ্যাস কমে যাচ্ছে। নতুন কোনো অনুসন্ধান নেই। আমাদের কয়লা মাটির নিচে রাখা হচ্ছে। সুতরাং এই যে আমদানি নির্ভরতা এটা যে কোনো দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমদানি নির্ভরতা যত বাড়বে ঝুঁকির মাত্রাও তত বৃদ্ধি পাবে। এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাড়াতে পারি। আমরা যদি দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তি করি তাহলে তুলনামূলক কম ব্যয়ে বিদ্যুৎ আমদানি করা যেতে পারে। কারণ ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ আমাদের তুলনায় কম। ভারতের নিজস্ব কয়লা আছে। এ ছাড়া তাদের কয়লা আমদানির অবকাঠামো অনেক ভালো। তারা যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমাদের নিকট রফতানি করে তাহলে খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম পড়বে। দ্বিতীয়ত,আমাদের ব্যাপকভাবে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করতে হবে। একই সঙ্গে নিজস্ব কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অতিমাত্রায় জ্বালানি শক্তি আমদানি নির্ভর হলে অর্থনীতিতে তার কি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তা আমরা ইতোমধ্যেই প্রত্যক্ষ করছি। সরকার সব সময় বলছেন, টাকার কোনো অভাব নেই। সব কিছু আমরা আমদানি করবো। সামনে আমরা এলএনজি আমদানি করতে যাচ্ছে। আমরা যদি প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করি তাহলে খরচ পড়বে ১০ ডলারে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমরা বর্তমানে সার্বিকভাবে জ্বালানি তেল আমদানি করছি ৩ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল অর্থ আমরা কোথায় পাবো? এই অবস্থায় স্থানীয় মুদ্রা টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন হবে। প্রতি মার্কিন ডলারের মূল্য বা বিনিময় হার ১০০ টাকায় গিয়ে ঠেকবে। এতে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি  ঘটবে। ফলে দেশে মারাত্মক মূল্যস্ফীতি ঘটবে। দেশের মানুষ চরম বিপাকে পতিত হবে। যে পরিস্থিতি আমরা ভারতের ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণেই ভারতীয় অর্থনীতিতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই জ্বালানি তেল আমদানি নির্ভরতা যত কমানো যায় ততই মঙ্গল। আমাদের দেশের অর্থনীতি একটা পর্যায়ে গেলে আমরা নিজেদের জাপান বা তাইওয়ানের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। আমাদের দেশের এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ জাপান,কোরিয়া,তাইওয়ান ইত্যাদি দেশের সঙ্গে তুলনা করেন। তারা বলেন,এসব  দেশ তাদের জ্বালানি চাহিদার পুরোটাই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনীতি তো সেই পর্যায়ে নেই। কাজেই তাদের সঙ্গে তুলনা করে কোনো লাভ হবে না। তারা প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ পণ্য রফতানি করে। কাজেই জ্বালানি তেল আমদানির জন্য অর্থ ব্যয় করতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু আমাদের রফতানি তো এতটা বৃদ্ধি পায় নি।

জাগরণ: সমুদ্র সীমানায় জ্বালানি তেল পাবার সম্ভাবনা কেমন বলে মনে করেন?

ম তামিম: ২০১৪ সালে আমাদের দুই প্রতিবেশি দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমা নির্ধারিত হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম শুরু করা হয় নি। দুই বার জরিপ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে সার্ভে করার জন্য। কিন্তু দুই বারই এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। এখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল। যে কারণে সার্ভে করার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। সার্ভে করা না হলে কোনো কোম্পানি এখানে আসবে না। একমাত্র সার্ভে করলেই আমরা জানতে পারবো সমুদ্রে কোনো তেল-গ্যাস পাবার সম্ভাবনা আছে কিনা।

জাগরণ: এই অবস্থায় বাংলাদেশ আপদকালিন জ্বালানি মজুদ গড়ে তোলার জন্য কি পদক্ষেপ নিতে পরে?

ম তামিম: আপদকালিন জ্বালানি মজুদ গড়ে তোলার মতো ক্ষমতা বা সামর্থ বাংলাদেশের নেই। জ্বালানি তেলের বিকল্প কিছু নেই। আমরা যদি এলএনজি গ্যাস আনতে পারি তাহলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেয়া যেতে পারে। কিন্তু এলএনজি আমদানি তো ব্যয় বহুল। তবে জ্বালানি তেলের তুলনায় এলএনজি আমদানি ব্যয় কিছুটা কম।  আমাদের এলএনজি আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা চাহিদা খুব একটা কমবে না।
 

জাগরণ: জাগরণের পক্ষ তেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
ম তামিম: ধন্যবাদ জাগরণকে।