• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২০, ২০২০, ০৭:৪০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ২০, ২০২০, ০৭:৪০ পিএম

‘দেশে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার কোনো অভিভাবক নেই’

‘দেশে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার কোনো অভিভাবক নেই’

এনামুল করিম নির্ঝর একাধারে একজন স্থপতি, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার ও সুরকার। দুই বছর ধরে বিনামূল্যে অমর একুশে গ্রন্থমেলার নকশা ও বিন্যাসের পরিকল্পনা করছেন তিনি। বইমেলা, সংগীত, চলচ্চিত্রসহ নানা বিষয় নিয়ে দৈনিক জাগরণের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।


জাগরণ : দুই বছর ধরে আপনি অমর একুশে গ্রন্থমেলার নকশা ও বিন্যাসের পরিকল্পনা করছেন। এবারের বইমেলা নিয়ে আপনার পরিকল্পনার কথা শুনতে চাই।
এনামুল করিম নির্ঝর :
পরিকল্পনা তো পরের ব্যাপার। আগে তো সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বইমেলা হবে কি হবে না? গত দুই বছর আমি বইমেলা পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলাম, স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজটা করেছি। এখন যাদের জন্য করেছি, তারা যদি বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, তাহলে আগে থেকেই আমাকে বলতে পারতেন―এবার তো করোনা মহামারি, অন্যদিকে স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি; এই পরিস্থিতিতে নতুন কী করা যেতে পারে? কীভাবে মেলাকে আগের চেয়ে নান্দনিক করা যেতে পারে? কিন্তু এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া মেলার বিন্যাস আমি ছাড়া যে-ই করুক না কেন, একটা প্রসেস তৈরি করে দেওয়া এবং সেই সঙ্গে একটা আগ্রহী দল তৈরি করে কাজটা সহজ করে দেওয়া খুব জরুরি। অনেকবার বলেও সেটা আসলে আমি কমিটিকে বোঝাতে পারিনি।

জাগরণ : আচ্ছা, তারপর?
নির্ঝর :
প্রশ্ন হলো, মেলা হবে কি হবে না? যা-ই হোক না কেন, আমাদের তো একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এর জন্য আলোচনায় বসতে হবে। সত্যি কথা বলতে আলোচনাটা আসলে আমরা শুরুই করতে পারিনি।

জাগরণ : মেলার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কোনো কথা হয়েছে কি?
নির্ঝর :
কর্তৃপক্ষ আমাকে গত নভেম্বর মাসে মৌখিকভাবে কাজ করতে বলেছেন। কিন্তু উত্তরে আমি বললাম, এভাবে মৌখিকভাবে বললে তো হবে না। আমাকে একটা চিঠি পাঠান। চিঠি পাঠানোর পর একটু সময় চেয়ে নিলাম। পরবর্তীকালে আমি কয়েকবার আলোচনা করতে চেয়েছি। এখন পর্যন্ত তারা আমাকে কিছুই জানায়নি। 

জাগরণ : তাহলে কোনো সিদ্ধান্তই এখন পর্যন্ত হয়নি বলছেন?
নির্ঝর :
মেলা কর্তৃপক্ষ সব সময় আশা করে যে আমি খোঁজ নিয়ে তথ্য জেনে নেব। ব্যাপারটা তো আসলে ঠিক না। কারণ, আয়োজনটা তো তাদের। তাদেরই তো সবার আগে আগ্রহ থাকতে হবে। এখনো ভালো কিছু হতে পারে। কিন্তু আমরা অভিমান করে বসে থাকব, তা তো হয় না। অপেক্ষা করছি, তারা সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই জানাবেন। তবে সময় কম। গত জুন মাস থেকে আমি বাংলা একাডেমিকে তাগিদ দিচ্ছি। তবু তাদের কোনো কর্ণপাত নেই। ভার্চুয়াল একচুয়াল যা-ই করি না কেন, আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

জাগরণ : বাংলা একাডেমির এ ধরনের আচরণে আপনি হতাশ মনে হচ্ছে।
নির্ঝর :
দেখুন, আমি কোনো অভিযোগ করছি না। আসলে আমাদের জাতীয় ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো কিছু চর্চার দিকে যাওয়া উচিত। তাহলে আমরা যারা স্বেচ্ছায় কাজ করে দিতে চাই, তারা আগ্রহী হয়ে উঠবে এবং উৎসাহ পাবে। যেহেতু স্বেচ্ছাশ্রমে কাজটা করে দেওয়া হচ্ছে, এতে বাংলা একাডেমির তো খুশি হওয়া উচিত, তাই না? সেখানে তারা যদি এমন আচরণ করে তাহলে ভবিষ্যতে অন্যরা কেন কাজ করতে আসবে? শুধু বাংলা একাডেমির কথা বলব না, সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা মেধাবী কাউকে সম্মান বা গুরুত্ব দিতে দেখা যায় না।

জাগরণ : মেলাটা কীভাবে হলে ভালো হয় বলে আপনি মনে করেন?
নির্ঝর :
একদিকে করোনা মহামারিতে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মেলাটা হবে, সেটা একটা বিষয়। অন্যদিকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি, প্রকাশকরা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের কীভাবে সহায়তা করা যায়, বইমেলাকে কীভাবে আরো সমৃদ্ধ করা যায়, তরুণদের কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, এমন একটা মেলা উপহার দেওয়া দরকার, যা ডিজাইনের মধ্যে ভিন্নতা ছিল, উপস্থাপনের নান্দনিকতা ছিল, জাতির কাছে একটি ভালো মেসেজ তুলে ধরা এবং সবশেষ হচ্ছে কাজটাকে এমন একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসা যাতে আগামী বছর অন্য কেউ কাজ করতে এলে তাকে যেন সুযোগ করে দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আগ্রহী নয়। তাদের যেটা স্বার্থে লাগে সেটা তারা কাজে লাগায়। এর বাইরে তারা কারো স্বার্থের চিন্তা করে না। এটা বলতে আমার দ্বিধা নেই। এখানে আমার কোনো স্বার্থ নেই, দেশের স্বার্থে কাজটা করে যাচ্ছিলাম। 

জাগরণ : কেমন আগ্রহী দল চেয়েছিলেন, একটু খুলে যদি বলতেন?
নির্ঝর :
প্রথম বিষয় হলো, সম্মান ও গুরুত্ব। আমি তো চেয়েছিলাম একটা আগ্রহী দল তৈরি করা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দায়বদ্ধতা চর্চার একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি করা। সেখানে আর্কিটেক্ট, গ্রাফিক ডিজাইনার থাকবে, লেখক, প্রকাশক, শিল্পী ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যমকর্মী, অগ্নিনির্বাপণকারী দল, স্বাস্থ্যকর্মী, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞসহ একটা টিম কাজ করবে। ভবিষ্যতে জাতীয় পর্যায়ে এমন আয়োজনের একটি অনুপ্রেরণার উদাহরণ তৈরি যাওয়া, যাতে বিভিন্ন সৃজনশীল পেশাজীবীরা যুক্ত হতে পারেন। বাংলা একাডেমি সেই দলটাকে আমন্ত্রণ জানাবে। প্রকাশকরাও থাকবেন। পারস্পরিক মতবিনিময়ে সফল একটি মেলা করা যেতে পারে। মেলাটি এমনভাবে তৈরি করা যেন, ভার্চুয়ালি দেখবেন, ফিজিক্যালি দেখবেন, শিশু থেকে শুরু বয়স্ক, নানা রকম, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যাতে দেখতে পারে―সব আয়োজন রাখা। ঢাকা ও এর বাইরের লোকেরা দেখতে পারবে। সারা পৃথিবীতে বাংলাভাষী যারা আছে, তারা দেখতে পারবে। 

জাগরণ : বিষয়টি আরো একটু ব্যাখ্যা করবেন প্লিজ?
নির্ঝর :
দেখুন, সময়টা আমাদের বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপনের। ব্যাপারটা আসলে সোজা কথা না। তুচ্ছ ব্যাপার নয়। ৫০ বছরের আয়োজন, হুট করে করে ফেলবেন, সেটা তো সম্ভব নয়। আমরা যারা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে আসছি, তাদের জন্য এমন শীতল আচরণ খুব দুঃখজনক, হতাশাজনকও। এরপর থেকে কেউ কেন এগোবে, সেটা নিয়ে ভাববে। আমি গভীর হতাশা নিয়ে কথাগুলো বললাম এ জন্য যে গত দুই বছরে বাংলা একাডেমি যে প্রশংসা পেয়েছিল, তাদের আসলে এটা ভাবা উচিত ছিল। আসলে সবাই মিলে একটি এককেন্দ্রিক সমন্বিত পরিচালনা চর্চার ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে চেয়েছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমি তাদের আগ্রহই দেখিনি। সে ক্ষেত্রে আমি গত জুন মাস থেকে বলছি, খুবই অল্প সময়। ৫০ বছরই একটা দেশের পার হয়ে গেছে। ৬ মাসের একটা প্রিপারেশন নিয়ে কীভাবে সেটা সম্ভব বলেন? একটা ছবি এঁকে দেখিয়ে দেবেন, বিষয়টা তো এমন না। 

জাগরণ : বইমেলার নানা দিক নিয়ে আপনি ভার্চুয়ালি বেশ কয়েকটি লাইভ অনুষ্ঠান করেছিলেন। কী বার্তা পেলেন সেখান থেকে?
নির্ঝর :
অনেকে তারিখ পরিবর্তনের কথা বলেছেন। বেশি সময় নেওয়ার কথা বলেছেন কেউ কেউ। আগ্রহী টিমকে কীভাবে সমৃদ্ধ করা যায়, সেটাকে সম্মান জানিয়ে, স্বাস্থ্য, জনসংযোগ এসব বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। 

জাগরণ : আপনি একজন চলচ্চিত্রকার। এসময়ে কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন?
নির্ঝর :
মূলত আমি একজন স্থপতি, যেটা আমার পেশাগত কাজ। এর বাইরে যেটা করি, সেটা হচ্ছে বুদ্ধিভিত্তিক জায়গা থেকে। যেমন আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং সংগীতের কাজ করি। মূলত যারা তরুণ, তাদের নিয়ে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৯টা বিষয়কে বেছে নিয়ে ৯টা ছবি বানানো হচ্ছে। কয়েকটি হয়ে গেছে। বাকিগুলো পরিস্থিতি বুঝে আমরা প্রকাশ করব। প্রচুর গান বানানো হচ্ছে। কিছু সামাজিক উদ্যোগ আছে, সেগুলো করা হচ্ছে। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, যেহেতু আমি শিল্পী, তাই কল্পনা করতে পারি। বাস্তবায়নের জন্য আমাদের রাষ্ট্র আছে। জনসম্পৃক্ত কিছু প্রজেক্ট আমরা দিয়েছি। এর বাইরে আমরা কিছু সামাজিক কাজ করছি। 

জাগরণ : আর আপনার গানের কথা? 
নির্ঝর :
আমি গান লিখে সুর করে দিই, যেটা আমার ইন্টেলেকচ্যুয়াল ইনভেসমেন্ট, সেটা ফ্রিতে দিই। লিখে সুর করে যাকে আমি মিউজিক করতে দিলাম, তাকে তো সংসার চালাতে হয়, যিনি গাইছেন বা যিনি রেকর্ড করছেন, তারও তো একটা সংসার আছে, পয়সা লাগে। তার মানে কি আমি যদি গান লিখে সুরটা না করতাম, তাহলে বাকিরা তো আয় করতে পারত না। এটা একটা প্রসেস আর কি। গান তো আমরা মনে করি এটা আবেগের জিনিস। কিন্তু যে শিল্পী গান গায়, যে যন্ত্রী বাজনা বাজায়, তাকে খেয়ে-পরে বাঁচতে হয়, বাড়িভাড়া দিতে হয়, তার বাচ্চাও তো স্কুলে যায়। এটা কোত্থেকে, কীভাবে হবে? এটার ইন্ডাস্ট্রিই তো নেই। এই জায়গাটাকে আমরা ডেভেলপ করার চেষ্টা করছি। 

জাগরণ :  আপনার সিনেমার কথা শুনতে চাই।
নির্ঝর :
সিনেমার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বিশেষ করে আমরা চেষ্টা করছি টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে, আমাদের যাতে কারো ওপর ডিপেন্ড করতে না হয়। এটার নাম হচ্ছে ইকেএমসি (এক নির্ঝর কোলাবোরেশন)। এটা বেসিক্যালি একটা কারণেই করা হচ্ছে। কারণ, আমি নিজেই ঢাকা শহরে এসে ক্রিয়েটিভ কাজ করতে করতে স্বাবলম্বী হয়েছি। চুরিও করতে হয়নি, চাকরিও করতে হয়নি, তেলও মারতে হয়নি। আমি যে কাজ করেছি, এটা যদি আমার জীবদ্দশায় একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে প্রজন্মের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। জরুরি বিষয় হচ্ছে, একই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্থাপত্য আছে, চলচ্চিত্র আছে, মিউজিক আছে, একই সঙ্গে কিছু সামাজিক চর্চাও আছে। এই প্রক্রিয়াটা যেন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি। একদিনে হবে না জানি। তবে, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

জাগরণ : বুদ্ধিভিত্তিক দিকটি নিয়ে একটু বলুন।
নির্ঝর :
মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, আমাদের এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক সব জিনিস, তা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে যত সাংস্কৃতিক কাঠামো আছে, সবখানে একদম ধ্বংস হয়ে গেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন মানুষ সস্তা পপুলার পছন্দ করে। সত্তর-আশির দশকে ভালো ভালো ছবি হতো, তখন সিনেমা হলে প্রচুর মানুষ ছবি দেখতে যেত। এখন কী হয়? এখন কি মানুষের মেধা-বুদ্ধি কমে গেছে? রুচি নষ্ট হয়ে গেছে?  না, চিন্তা করে বা চিন্তা না-করে এটাকে দিনে দিনে ধ্বংস করা হয়েছে। এই যে আমরা রুচিহীন হয়ে গেছি, শিক্ষার মান কমে গেছে, চিন্তার ক্ষমতা কমে গেছে, তাতে দেখবেন ঝগড়াঝাঁটি বেশি হচ্ছে। মূর্খরা অনেক বেশি কথা বলে (আমিও বেশি কথা বলছি, আমিও মূর্খ)। এবং অনেক আর্গুমেন্ট করে। দেখবেন টক শোগুলোতে চিৎকার করে কথা বলতে থাকে তারা। ধর্মীয় সভাগুলোতে কিভাবে চিৎকার করে কথা বলে! এত বেশি চিৎকার করে বলার তো কোনো প্রয়োজন নেই। সবাই কি বোকা, গাধা? কেউ কি কিছু জানে না? এই যে সর্বনাশ হয়ে গেল, এর পেছনে আমি মনে করি, আমাদের দেশে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার কোনো অভিভাবক নেই। কেউ নেই, নট আ সিঙ্গেল পারসন। তারপরও নগরসেবাটা কেন করছি? কারণ, চেষ্টা করছি একটু নজরকাড়ার জন্য। ফলে গান বলেন, সিনেমা বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে সবকিছু হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

জাগরণ : কালচার চর্চার বিষয়টি আসলে কী বোঝাতে চাচ্ছেন?
নির্ঝর :
কালচার বলতে আমরা শুধু গান, বাজনা, সিনেমা নৃত্য বুঝি না। কালচার হচ্ছে একটা সমাজের সবচেয়ে বড় শক্তি, চর্চাটাই হচ্ছে কালচার। এটার জন্য আমাদের অনেক বেশি ইন্সপায়েরেশন লাগে। এর জন্য ছবি লাগে, বই লাগে, ভালো সাহিত্যচর্চা লাগে, সংগীতচর্চা লাগে। কালচারের চর্চাটা বাঙালিদের মধ্যে আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমাদের এখানে আগেও অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। আগে তো এত অসাধুতা ছিল না, এত মিথ্যাচার ছিল না, এত অন্যায়-অবিচার ছিল না। এই যে ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়ে যাচ্ছে, এটা নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। এত কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ভুলে গেছে। ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে? কেউ এর প্রতিবাদ করছে না। এ নিয়ে কোনো কথা বলছে না। একসময় সবাই সস্তা বিনোদন খুঁজবে, যেটা এখন হচ্ছে, যার মধ্যে চিন্তার কিছু নেই। সেজন্য আমি মনে করি বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে মেরামত করা উচিত। আসলে এখনো সময় আছে উত্তরণের। যারা যারা আগ্রহী তাদের একা বসে থাকলে হবে না। আমি মনে করি, এখন একজোট হওয়ার সময়, নানা পরিকল্পনা করে ব্যক্তিস্বার্থ বাদ দিয়ে প্রচুর কাজ করতে হবে। কাজ করলে আসলে পরিবর্তন আসবে।

জাগরণ : এটা কিভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করেন?
নির্ঝর :
দেখুন, যারা দেশ চালান, তারাই তো আমাদের অভিভাবক। সেই জায়গা থেকে আমাদের বর্তমান সরকারের কাছে আমার বড় একটি আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে। সরকার চাইলে সংস্কৃতিচর্চার জন্য অনেক কিছু করতে পারে। যেমন বইমেলার কথাই ধরুন। বইমেলার জন্য কেন বাজেট দেবেন না তারা? আমি মনে করি, প্রতিটি জায়গাতে ঠিক মানুষগুলোকে বের করে আনতে হবে। 
চাটুকাররা কখনো কারো কাজে লাগে না, ঠিক মেধাবী মানুষগুলো খুঁজে বের করতে হবে। এটা সরকারের দায়িত্ব। অনেকেই বসে আছে, যারা ডাকলেই চলে যাবে। এ কারণে বোর্ড বসিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। সেই বোর্ডে কাদের কাদের বসানো হবে, তাদের সম্মানের সাথে বসানো দরকার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এটা একটা বিরাট সুযোগ। এই সুযোগ যদি হাতছাড়া হয়, আমি মনে করি, পরে তাদের পস্তাতে হবে।

জাগরণ : ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজতে ইসলাম প্রশ্ন তুলছে। একজন স্থপতি হিসেবে আপনার এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া কী?
নির্ঝর :
সামগ্রিকভাবে নিজস্ব জায়গা থেকে পরিষ্কার করে একটা কথা বলি, গত বছর হজ করে এসেছি, আমি মুসলিম। ধর্মটা এমন একটা জিনিস, যার মধ্যে বিশাল উদারতা আছে। আমি যদি প্রকৃতভাবে ধর্মের চর্চা করি, অন্যের চর্চাকেও আমার শ্রদ্ধা করতে হবে। আমাদের ধর্ম তো এত ঠুনকো নয়। আসলে ঘুম থেকে উঠে তারা একেকটা করে ইস্যু তৈরি করে। আমি মনে করি, এসব কটিই রাজনীতির অংশ। কারণ, সমাজকে যতটা অস্থির রাখা যায়, রাজনৈতিকভাবে কেউ না কেউ ফায়দা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। এসব ইস্যু বিভাজনের একেকটা প্রক্রিয়া। বিভাজন হতে হতে আমরা তো একা হয়ে গেছি এবং এটা আরো চলবে। এ জন্য আমি মনে করি, এসব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা দরকার, জানা দরকার। নয়তো কথা বলা উচিত নয়। হুট করে একটা কথা বলা ঠিক নয়। যেহেতু আমার কথা অনেকে শুনবে, তাই দায়িত্ব নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে। কথাগুলো বলতে গেলে মার্জিতভাবে সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে হবে। এটা ঝগড়াঝাঁটির বিষয় নয়। আমি যখন বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করবো, তখন আমার বলার ভঙ্গি ও উচ্চারণই বলে দেবে আমি আসলে কী চাচ্ছি। এসব নিয়ে যুদ্ধ করার জায়গা আসলে এটা না। যুদ্ধ করে কেউ কিন্তু ধর্মচর্চা করেনি।

জাগরণ : আর শিল্পের দিক থেকে?
নির্ঝর :
শিল্পকর্ম তো স্থূল কোনো বিষয় নয়। এটা একটা বিশাল আর্ট। শিল্পের জায়গা থেকে আমরা এত বেশি পিছিয়ে গেছি, আসলে কিছু বলার নেই। শিল্পকর্ম তো রাখতেই হবে। সেটা চমৎকারভাবে উপস্থাপনও করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, এটা মানুষের কেন লাগবে। শিল্পীর দায়িত্ব আছে, কর্তৃপক্ষের ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। আমাদের যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আছে, এটা কেন বসে আছে? কার জন্য বসে আছে? এদের কাজটা কী? আমাদের ট্যাক্সের টাকায় তারা চলে। কী কাজটা করছে তারা? ওদের কাজই তো হচ্ছে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং ভালো ভালো কাজকে উৎসাহ দেওয়া। শিল্প-সাহিত্য কী জিনিস, সেটা মানুষকে বোঝাতে হবে। এটা কেন লাগবে, তাও সবাইকে পরিষ্কার করতে হবে। সবকিছু মিলে আমাদের অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে।