• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০১৯, ০৩:৩৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০১৯, ০৯:০২ পিএম

সাক্ষাৎকার

কৃষি ব্যবস্থার যান্ত্রিকায়ন খুবই জরুরি

কৃষি ব্যবস্থার যান্ত্রিকায়ন খুবই জরুরি
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ; ফাইল ফটো

 

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান। তিনি একান্ত সাক্ষাৎকারে নতুন সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন। এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলে দেশ দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলে মনে করেন। দৈনিক জাগরণের পক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন এম এ খালেক। 

জাগরণ : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেছে। এসব নির্বাচনি ইশতেহারে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সব অঙ্গীকার করা হয়েছে, তার বৈশিষ্ট্য কি বলে মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : নির্বাচনি ইশতেহারের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। কারণ নির্বাচনি ইশতেহারের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল জনগণের নিকট তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি তুলে ধরে। তারা আগামীতে কি করতে চায়, কীভাবে করতে চায়Ñ এসব পরিকল্পনা তুলে ধরে। ভোটাররা রাজনৈতিক দলের এ ইশতেহারের ওপর নির্ভর করে ভোটদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু আমাদের দেশে, এমনকি নিকটপ্রতিবেশী কোনো কোনো দেশে দেখা গেছে, নির্বাচনি ইশতেহার ইশতেহারের জায়গায় থাকে। আর বাস্তবায়ন বাস্তবায়নের জায়গায় থাকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনি ইশতেহারের কোনো মিল থাকে না। আমরা সাম্প্রতিক নিকটঅতীতের ৩ বা ৪টি নির্বাচনের ইশতেহার পর্যালোচনা করে দেখেছিÑ তারা ইশতেহারে বলেছে এক কথা, আর বাস্তবে করেছে অন্য কাজ। এটা অবশ্য কিছুটা যৌক্তিকও। কারণ অনেক সময় এমন পরিস্থিতি সামনে এসে যায়, যখন সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। অথবা বাস্তবতার কারণে নির্বাচনি ইশতেহারে বর্ণিত অঙ্গীকারগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায় না। এটা আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে যে সব রাজনৈতিক দল ইশতেহার ঘোষণা করেছে, তা নানা কারণেই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমরা যদি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারের অর্থনৈতিক দিকগুলোর দিকে তাকাই তা হলে দেখব তারা জনকল্যাণে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেছে তাতে এক ধরনের ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়। তারা গত দুই টার্ম বা ১০ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে। তারা বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। তাদের সেই উন্নয়নমূলক কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং তাকে আরও বেগবান করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে যে সব মেগা প্রকল্প তারা গ্রহণ করেছে, তা দ্রুত এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়নের কথা  বলেছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে অধিকাংশ অর্থনৈতিক সূচকে উন্নতি হয়েছে। নির্বাচনি ইশতেহারে সেই সাফল্যের বিষয়গুলো তুলে ধরে এগুলোকে আরও ত্বরান্বিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে আগামীতে আরও বেগবান করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। যেমন- বেসরকারি খাতকে কীভাবে আরও চাঙ্গা করা যায়, তারা সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতকে আরও সম্প্রসারিত করা, মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি অঙ্গীকার করেছে। ৮৩ পৃষ্ঠার নির্বাচনি ইশতেহারে তারা অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। পক্ষান্তরে বিএনপি যেহেতু অনেক দিন ধরেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করছে, তাই তারা যে সব অঙ্গীকার করেছে তা মূলত সংস্কারমূলক। তারা অতীতের ধারাবাহিকতা নিয়ে কিছু বলতে পারেনি বা বলেনি। বিএনপি সরাসরি অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ে তেমন কিছু বলেনি। বরং তারা কিছু পদ্ধতিগত সংস্কারের কথা বলেছে। তারা দাবি করছে, প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলেই দেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে, যা প্রকারান্তরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। তারা বলেছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করা হবে। কেউ যাতে দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, তার বিধান করা হবে। সরকারি চাকরির বয়সসীমা তুলে দেয়া হবে। এগুলো খুবই উচ্চ মার্গের সংস্কার প্রস্তাবনা। এগুলো কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, সেটা পরবর্তী বিবেচ্য বিষয় বটে। পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। তারা ক্ষমতায় গেলে ৫ বছরে ১ কোটি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবেন। 

জাগরণ : কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নির্বাচনি ইশতেহারে তা প্রায় একই রকম। বিএনপি বলেছে, তারা ক্ষমতাসীন হলে আগামী ৫ বছরে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবেন। আওয়ামী লীগ ১ কোটি ২৮ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কথা বলেছে। এটা কীভাবে সম্ভব হবে বলে মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : বর্তমান সরকার এবং তারও আগের সরকারগুলোর আমলে আমরা দেখেছি কর্মসৃজন হয় মূলত বেসরকারি খাতে। সরকারি খাতে কর্মসৃজনের হার খুবই কম। ব্যক্তিখাতের বিকাশ না ঘটলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় না। উন্নয়ন হয় বেসরকারি খাতের বিকাশের মাধ্যমে। সরকার শুধু উন্নয়নের জন্য সুযোগ সৃষ্ট করে দেয়। আর ব্যক্তিখাত সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম গতিশীল এবং ত্বরান্বিত করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে যে বিনিয়োগ বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকা- সম্পাদিত হয়েছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে সরকারি খাতে। সরকারি খাতে বড় বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু সেখানে নতুন কর্মসৃজনের সুযোগ ছিল খুবই কম। যদিও কর্মসৃজন নামে একটি সরকারি প্রকল্প আছে। কিন্তু সেখানেও তেমন একটা নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ বলেছে, তারা আগামী ৫ বছরে ১ কোটি ২৮ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এটা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী একটি পরিকল্পনা। তবে এ কার্যক্রম তখনই সফলতার মুখ দেখবে যখন বেসরকারি খাত চাঙ্গা হবে। অর্থাৎ ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলই তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর জোর দেয়ার কথা বলেছে। কিন্তু তারা কীভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ আহরণ করবে, সেটা দেখার বিষয় বটে। এ মুহূর্তে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত ও গতিশীল করার জন্য ব্যক্তিখাতের বিকাশ ব্যতীত কোনো গত্যন্তর নেই। বেসরকারি খাত যদি সত্যি বিকশিত হয়, তা হলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। 

জাগরণ : দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ চলছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে গতিশীলতা আসবে বলে মনে করেন কি?

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সব বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হতে যাচ্ছে, তা নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। আমরা যদি অতীত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিই তা হলে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের মতো দেশের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতই হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি, ইপিজেডগুলোয় প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হলে প্রথমত দুটি বিশেষ লাভ হয়। প্রথমত, একটি নির্দিষ্ট এলাকায় শিল্পের স্থানীয়করণ হয়, যেখানে সব ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা পাওয়া যায়। অর্থাৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনিং সৃষ্টি হয়। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থানীয় ও বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কারণ ন্যূনতম সময়ের মধ্যে সেখানে প্রয়োজনীয় সব সার্ভিস পাওয়া সম্ভব। অর্থনৈতিক অঞ্চলে যে সব শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়, তার প্রায় সবই শ্রমঘন শিল্প। কাজেই এখানে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বাস্তবায়িত হলে এগুলো নতুন কর্মসৃজনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আওয়ামী লীগ আগামী ৫ বছরে যে ১ কোটি ২৮ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কথা বলেছে, তা অবশ্যই অর্জনযোগ্য একটি পরিকল্পনা। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ক্ষেত্রে যে সব সমস্যা আছে তা নিরসনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- জমির ক্রয় বা অধিগ্রহণের সমস্যা। প্রকল্পের জন্য জমি  ক্রয়ের ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিল সমস্যায় পড়তে হয়। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি ক্রয় বা অধিগ্রহণের যে সমস্যা তা সমাধানের জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকার নিজেই মীরসরাই বা আরও কোনো কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে দিয়েছে। আমার মনে হয়, বিদ্যমান বাস্তবতায় ভূমিসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য এটাই উত্তম পন্থা হতে পারে। যেমনÑ শ্রীলঙ্কায় সরকার নিজে জমি অধিগ্রহণ করে তা উদ্যোক্তাদের মাঝে বরাদ্দ দিচ্ছে। ফলে কার্যত পুরো শ্রীলঙ্কাই এখন অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। আমাদের এখানেও সরকার নিজ উদ্যোগে জমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন করে তা ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তাদের নিকট হস্তান্তর করতে পারে। কারণ বিদ্যমান অবস্থায় দেশের অনেক সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তা শুধু জমি ক্রয় বা অধিগ্রহণ করতে না পারার কারণে নির্ধারিত সময়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করতে পারছেন না। হয়তো দেখা গেল, কোনো জমির ওয়ারিশান তিনজন। এর মধ্যে দুজন জমি বিক্রি করতে রাজি হলো, কিন্তু একজন কোনোভাবেই জমি বিক্রি করবেন না। তা হলে সেই জমি তো আর কেনা যাবে না। প্রসঙ্গক্রমে আমি লক্ষ্মীপুরের একটি প্রকল্পের কথা উল্লেখ করতে চাই। এক ভদ্রলোক ২৫ বিঘা জমি দিলেন একটি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের জন্য। সবকিছুই ঠিকঠাকমতো চলছিল। কিন্তু তার পরিবারের একজন সদস্যের প্রকল্প এলাকার ঠিক মাঝখানে ৫ কাঠা জমি ছিল। তিনি কোনোভাবেই হাসপাতাল তৈরির জন্য জমি বিক্রি করবেন না। তাকে এ জমির বিনিময়ে প্রকল্প এলাকার বাইরে ২৫ বিঘা জমি দেয়ার কথা বলা হলো। কিন্তু তিনি এতে রাজি হলেন না। ফলে প্রস্তাবিত হাসপাতালটি স্থাপন করা যাচ্ছে না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো স্থাপন বিলম্বিত হতে বাধ্য। 

জাগরণ : আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঙ্গীকার হচ্ছে, শহরের সুবিধাকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া। এটা কতটা বাস্তবসম্মত বলে মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ আবদুুল মজিদ : আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়ার যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক একটি ইস্যু। কারণ শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একটি সিদ্ধান্ত বলেই আমার মনে হয়েছে। কারণ আমাদের দেশের অর্থনীতি কার্যত শহরকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। এখনই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা শহরে পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামে তেমন কোনো সুবিধা পাওয়া যায় না। ফলে মানুষ বিশেষ করে যারা একটু সামর্থ্যবান, তারা গ্রামে থাকতে চাচ্ছেন না। শহরে চলে আসছে। গ্রামে উন্নত চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থানের ব্যাপকভিত্তিক সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি উপেক্ষিত হচ্ছে। গ্রামে পুষ্টিকর খাবার উৎপন্ন হচ্ছে, কিন্তু সেই খাবার শহরে চলে আসছে। গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় শহরে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষের আগমন ঘটছে। ফলে শহর ও গ্রামের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত শতাব্দীর ’৮০-এর দশকে এরশাদ সাহেব যে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেছিলেন, তার উদ্দেশ্যও অনেকটা এমনই ছিল। তিনি চেয়েছিলেন শহরের সুবিধা যাতে গ্রামেও সম্প্রসারিত করা যায়। উপজেলায় যদি সরকারি অফিস-আদালত করে দেয়া যায়, তা হলে মানুষ শহরমুখী হবে না। আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়ার যে অঙ্গীকার করেছে, তা অত্যন্ত বাস্তবধর্মী একটি উদ্যোগ। শহরে বিদ্যমান আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যদি গ্রামেও সম্প্রসারিত করা যায়, তা হলে মানুষ শুধু শুধু শহরে আসবে না। এতে শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে শহরের সঙ্গে গ্রামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে বৈষম্য বিদ্যমান, তাও কমে আসবে। ফলে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। জাতীয় অর্থনীতিতে গ্রামের অবদান আরও বৃদ্ধি পাবে। গ্রামে যদি ভালো স্কুল-কলেজ স্থাপন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, তা হলে গ্রামের মানুষ এখনকার মতো শহরে আসতে চাইবে না। শহরের সুযোগ-সুবিধা যদি গ্রামাঞ্চলেও সম্প্রসারিত করা যায়, তা হলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে চমৎকার গতিশীলতা সৃষ্টি হবে। এতে শহর ও গ্রামের অর্থনীতির যে ব্যবধান তা হ্রাস পাবে। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে সব এলাকা এবং সকল স্তরের মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের এ পরিকল্পনা গ্রাম ও শহরের মাঝে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে সহায়তা করবে। 

জাগরণ : আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে কৃষি যান্ত্রিকায়নের কথা বলা হয়েছে। কীভাবে কৃষি যান্ত্রিকায়ন করা যেতে পারে এবং কৃষি যান্ত্রিকায়ন করা হলে উদ্বৃত্ত কৃষি শ্রমিকের কর্মসংস্থানের কী ব্যবস্থা করা হবে?

ড. মোহাম্মদ আবদুুল মজিদ : আমাদের উন্নত বিশে^র কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য ক্রমাগত কৃষি যান্ত্রিকায়নের দিকে যেতে হবে। কৃষি যান্ত্রিকায়ন ব্যতীত কৃষি খাতের সম্ভাবনাকে পুরো মাত্রায় ব্যবহার করা যাবে না। বাংলাদেশের কৃষি খাতের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। কিন্তু এখনো সেই সম্ভাবনাকে আমরা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছি না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিগত ৪৭ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে উন্নতি অর্জন করেছে, তার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে কৃষি খাত। বিশেষ করে কৃষক এ অবদানের কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। সেই ’৮০-এর দশক থেকে টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শাইখ সিরাজ যে কাজ করে চলেছেন, সাধারণ মানুষ তা অনুসরণ করছে। কৃষক তার জমিতে নানা ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি এবং টেকনিক ব্যবহার করে কৃষির উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছেন। ’৭০-এর দশকে যেখানে বাংলাদেশে ১ কোটি টন চাল উৎপাদিত হতো, আজ সেখানে ৩ কোটি ৬২ লাখ টন চাল উৎপন্ন হচ্ছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। তখন দেশে খাদ্যাভাব ছিল। বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটি অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু খাদ্যাভাব নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ এখন খাদ্যশস্য রফতানির স্বপ্ন দেখছে। আমাদের দেশের কৃষিব্যবস্থায় অনেক দিন ধরেই যান্ত্রিকায়ন চলছে। আগামীতে এ প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত ও ত্বরান্বিত করার কথা বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেছে। এর পেছনে কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের পাশাপাশি প্রাকৃতিক আনুকূল্যও বিশেষ অবদান রেখেছে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, বিগত ১০ বছরে দেশে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়নি। ফলে কৃষক নিরলসভাবে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান স্থিতিশীল রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বেড়েছে। কৃষি যান্ত্রিকায়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ খাতে উৎপাদনশীলতা আরও বাড়ানো। বাংলাদেশের কৃষি খাত অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। কিন্তু সেকেলে ধরনের চাষাবাদের ফলে সেই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আমরা যদি দ্রুত ও পরিকল্পিত কৃষি যান্ত্রিকায়ন করতে পারি, তা হলে বিদ্যমান অবস্থাতেই কৃষির উৎপাদন অনেকগুণ বাড়ানো সম্ভব। 
কৃষি যান্ত্রিকায়ন করা হলে কৃষি খাতে যে শ্রমিক উদ্বৃত্ত হবে, তাদের অন্যত্র কর্মসংস্থান বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যাবে। কারণ কৃষি যান্ত্রিকায়নের পাশাপাশি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠবে। উদ্বৃত্ত কৃষি শ্রমিকদের সেখানে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়া কৃষি যান্ত্রিকায়নের ফলে কৃষি খাতে যে আয় বর্ধন হবে, তা দিয়ে উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যবস্থা করা যাবে। এমনকি তাদের স্কিল বৃদ্ধি করে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে পাঠানো যেতে পারে। জনশক্তি উদ্বৃত্ত হলে এটা দোষের কিছু নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারছি কিনা। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা গেলে জনশক্তি রফতানি করে প্রচুর অর্থ আয় করা যেতে পারে।                                     
         
জাগরণ : রাজস্ব আয় একটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অর্জিত রাজস্ব দ্বারাই সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ভার নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজস্ব আয় আদায়ের হার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ আবদুুল মজিদ : আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। যে কোনো রাষ্ট্রের সরকারের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকল্পে পর্যাপ্ত পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের কোনো বিকল্প নেই। আমরা দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও তুলনামূলকভাবে কম। অর্থাৎ এটা প্রমাণ করে যে, আমাদের অর্থনীতিতে এক ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে। আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষ আয় করছে কিন্তু আয়কর দিচ্ছে না। ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে এবং বিদ্যমান বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের মতো দেশের অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে জিডিপির অনুপাতে যে পরিমাণ ট্যাক্স আদায় হওয়ার কথা, তার চেয়ে অন্তত ৫ থেকে ৬ শতাংশ কম ট্যাক্স আদায় হচ্ছে। অর্থাৎ বিদ্যমান অবস্থাতেই অর্থনীতির এ পরিমাণ ট্যাক্স আদায়ের সক্ষমতা আছে। এ জন্য অর্থনীতিকে বড় করতে হবে না। অর্থাৎ এ পরিমাণ ট্যাক্স প্রদানের সক্ষমতা আছে কিন্তু আমি দিচ্ছি না বা আদায় করতে পারছি না। ট্যাক্স আদায় করতে না পারার সঙ্গে ঘাটতি বাজেটের সংযোগ রয়েছে। আমরা যদি সামর্থ্য অনুযায়ী ট্যাক্স আদায় করতে পারতাম, তা হলে বাজেট ঘাটতি হতো না বা হলেও অনেক কম হতো। এ রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি এটা নির্দেশ করে যে অর্থনীতিতে বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে। কিছু দিন আগের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তিদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশে^র মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এটা হচ্ছে। কারণ এখানে যাদের ট্যাক্স প্রদানের ক্ষমতা বা সক্ষমতা আছে, তাদের অনেকেই ট্যাক্স দিচ্ছেন না। এরা ট্যাক্স দিচ্ছে না বলে রাষ্ট্র ট্যাক্স বাবদ প্রাপ্ত টাকা জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারছে না। এই যে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিওর যে পার্থক্য এটা ইঙ্গিত করে যে স্ট্যাকচারাল বিভ্রান্তি আছে এবং এ কারণে সমাজে অর্থনৈতিক বঞ্চনা-শোষণ বাড়ছে। একজন মানুষ অর্থ উপার্জন করছে কিন্তু তা প্রকাশ করছে না। ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তিনি এই অর্থ ব্যবহার করতে পারছে না। তাই পাচার করছে। এটা একটি দেশের অর্থনীতির জন্য রক্তক্ষরণ ছাড়া আর কিছু নয়। যারা ট্যাক্স দিচ্ছে না তারা প্রকারান্তরে ইনফ্লেশন বাড়াচ্ছে। ফলে যারা নির্ধারিত আয়ের মানুষ তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 
এই যে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিওতে ৫ বা ৬ শতাংশ গ্যাপ, সে বিষয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে এর পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে, আয় করছে কিন্তু রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত ট্যাক্স প্রদান করছে না। যারা অর্থ উপার্জন করছেন কিন্তু ট্যাক্স দিচ্ছেন না, তাদের যে কোনো মূল্যেই হোক করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দেখা যাচ্ছে, শুধু ব্যক্তিই কর ফাঁকি দিচ্ছে না তা নয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অনেক প্রতিষ্ঠানও কর খেলাপি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের ট্যাক্স সঠিকভাবে প্রদান করত, তা হলে ট্যাক্স আদায়ের হার আরও ২ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেত। উপরন্তু ট্যাক্স আদায়সংক্রান্ত বহু মামলা কোর্টে আটকে আছে। নির্ধারিত সময়ে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে যে টাকা হয়তো এই বছরই পাওয়ার কথা ছিল, তা পাওয়া গেল ৪ বছর পর। এতে টাকার অবমূল্যায়নজনিত সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। কাজেই ট্যাক্স আদায়সংক্রান্ত মামলা যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর রেয়াত দেওয়ার বিধান চালু রয়েছে। এটা যৌক্তিকীকরণ করা দরকার। ঢালাওভাবে কর রেয়াত দেয়া ঠিক নয়। অতিরিক্ত কর রেয়াত দেওয়ার ফলে তিনটি ক্ষতি হয়। প্রথমত, কর রেয়াত দেয়ার ফলে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। একই জাতীয় দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি যদি কর রেয়াত পায়, তাহলে যে প্রতিষ্ঠানটি কর রেয়াত পেল না তারা বাজারে অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে। কর রেয়াতপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে সাধারণ মানুষ এর কোনো বেনিফিট পাচ্ছে কিনা তা যাচাই করার ভালো কোনো পদ্ধতি নেই। কর প্রদানের ব্যবস্থা থাকলে হিসাবের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। কারণ কর প্রদান করা হলে তার হিসাব সংরক্ষণ করতে হয়। 

জাগরণ : নতুন ভ্যাট আইন আরও দুই বছর আগে চালু হওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। আগামী অর্থবছর থেকে এটা চালু হবে। এতে রাজস্ব আদায় কি কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : নতুন ভ্যাট আইন বলা হলেও এটা আসলে নতুন কোনো আইন নয়, বরং এটা হচ্ছে বিদ্যমান ভ্যাট আইনের সংস্কার মাত্র। কারণ ভ্যাট আইন ১৯৯১ সালে প্রণীত হয়। কাজেই নতুন ভ্যাট আইন বলতে আমরা ১৯৯১ সালে প্রণীত ভ্যাট আইনকেই বুঝি। বিদ্যমান ভ্যাট আইনে যে সব সীমাবদ্ধতা আছে, তা দূর করার জন্যই ২০১২ সালে এ সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ১৯৯১ সালে যখন ভ্যাট আইন প্রণীত হয় তখন দেশের অর্থনীতির আকার ছিল তুলনামূলক ক্ষুদ্র। এ ছাড়া ভ্যাট আইনটি অত্যন্ত স্বল্পসময়ের মধ্যে প্রণয়ন করা হয় বলে এর সীমাবদ্ধতাগুলো সেভাবে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি। আইএমএফের শর্তানুযায়ী, অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে ভ্যাট আইনের সংশোধনী আনা হয়। যে কারণে অংশীজনদের সঙ্গে ভালোভাবে আলাপ-আলোচনা করার সুযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে সংস্কারকৃত আইনের বাস্তবায়নযোগ্যতা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি। ২০১২ সালে এ আইনি সংস্কারটি অনুমোদিত হয়। তখন ছিল সেই সরকারের প্রান্তিক কাল। কোনো সরকারই তার মেয়াদের প্রান্তিক কালে এমন একটি আইন প্রয়োগ চাইবেন না। ফলে সেই সময় সংশোধিত ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা হয়নি। মনে করা হয়েছিল, ২০১৫ সালে নতুন সরকার এসে এ আইন বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু সেই সময় সরকার ততটা শক্তিশালী অবস্থানে ছিল না। ফলে কালক্ষেপণ করতে করতে ২০১৮ সালে এ আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু পুনরায় এর বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেয়া হয়। ২০১৯ সালে সংশোধিত ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। আমি মনে করি, সংশোধিত ভ্যাট আইন ঢাকঢোল পিটিয়ে বাস্তবায়নের দরকার নেই। কারণ ইতোমধ্যেই এর অনেক সংস্কার সাধন করা হয়েছে। সংশোধিত ভ্যাট আইনের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল এতে ফ্ল্যাট রেটে সব ক্ষেত্রেই ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের কথা বলা হয়েছে। এটা আমাদের দেশের জন্য কতটা প্রয়োগযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কারণ আমাদের অর্থনীতিতে নানা ধরনের ধাপ রয়েছে। কাজেই সবার জন্য একই হারে অর্থাৎ ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের উদ্যোগ নিয়ে কথা উঠতেই পারে। অনেক দেশেই ফ্ল্যাট রেটে ভ্যাট আরোপের বিধান নেই। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও একই হারে ভ্যাট আরোপের বিধান নেই। উন্নত দেশগুলোতে একই রেটে ভ্যাট আরোপ করা হয়। আমাদের দেশে ৭/৮টি স্তরে ভ্যাট আরোপ করা হতো। সেখানে হঠাৎ করে সবার জন্য একই হারে ভ্যাট আরোপ করার ফলে সংশ্লিষ্ট মহলে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। চলতি অর্থবছরে এ সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছে। ফ্ল্যাট রেটের পরিবর্তে ২/৩টি ধাপ সৃষ্টি করা হয়েছে।


জিএম