• ঢাকা
  • বুধবার, ০১ মে, ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২১, ০৮:৫৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ৮, ২০২১, ১১:৫৪ পিএম

আকিমুন রহমান

‘নারী-পুরুষ উভয়ই প্রেমের সংকটে ভোগে’

‘নারী-পুরুষ উভয়ই প্রেমের সংকটে ভোগে’

আকিমুন রহমানের জন্ম ১৯৬০ সালে নারায়ণগঞ্জে। মূলত তিনি ঔপন্যাসিক ও গল্পকার, প্রবন্ধও লিখেছেন। পাশাপাশি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। বিবি থেকে বেগম, পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে, আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ, সোনার খড়কুটো, রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি, এইসব নিভৃত কুহক, জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত, নিরন্তর পুরুষ ভাবনা, পৌরাণিক পুরুষ, বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ), সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন আদিপর্ব, যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়, অচীন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী তাঁর উল্লেখযোগ্য বই।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দিবসের ভাবনা, নারীর স্বাধীনতা, নারীর অধিকার, সাহিত্যে নারী, নারী অগ্রযাত্রা, ব্যক্তিজীবনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন দৈনিক জাগরণের সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।


জাগরণ: পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

আকিমুন রহমান: বিষয়টা দুইরকমভাবে দেখা যায়। বাহ্যিকভাবে যদি বলি তাহলে আমরা দেখবো যে, ক্রমে ক্রমে বেশ অগ্রসরতার লক্ষণ চারপাশে দেখা যাচ্ছে। যেমন আমাদের বাঙালি মুসলমান সমাজের জন্য বেগম রোকেয়ার বিষয়টাকে যদি ধরি, “মেয়েগুলাকে শিক্ষিত করিয়া ছাড়িয়া দাও, যাতে অন্নবস্ত্রের সংস্থাপন তারা নিজেরাই করে নিতে পারে।” রোকেয়া যেটা চেয়েছিলেন। আমাদের মেয়েদের বড় একটা অংশ কিন্তু শিক্ষিত হয়ে উঠেছে। যে নারীরা শিক্ষিত হননি যারা পেটের দায়ে বা নানারকম আত্মসামাজিক দায়ে বেরিয়ে আসছেন তারাও কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে কোনো না কোনোরকম স্বাবলম্বীর দিকেই আছেন। আর বিদ্যাসাগর যেমন চেয়েছিলেন বাঙালি হিন্দু সমাজে নারীদের জন্য যেমন জীবনের প্রাণ সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন যেখানে তাদের বেঁচে থাকার অধিকার ছিলো না, পুড়িয়ে মারা হতো, বিধবা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সহমরণ যেটা রামমোহন রায় বন্ধ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বেঁচে থাকার অধিকারটা দিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর দিয়েছিলেন যে, এরপরও এরা জীবন পাক। এরকম বহুবিবাহ এবং বাল্যবিবাহের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাক। তারপর তো রোকেয়া এসে আমাদের জন্য যে কথাগুলো বললেন, পরে আমরা দেখেছি যে, আমার অনেক জায়গা থেকেই মুক্তি পেয়ে গেছি। আমরা বেঁচে থাকতে পারছি, আমরা কর্মজীবী হচ্ছি, শিক্ষা পাচ্ছি। নারীরা করপোরেট প্রধান হচ্ছেন, বিভিন্ন বাহিনীতে আছেন, শ্রমসাধ্য অনেক কাজ করছেন, নানা রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কাজ করছেন, নারীরা লিখছেন, প্রকৌশলী হচ্ছেন। তো, বাহ্যিকভাবে আমার দেখতে পাচ্ছি অগ্রসরতা অনেকখানি আসছে। এটা হচ্ছে বাহ্যিক আমাদের পরিস্থিতি।

কিন্তু আসলে বিষয়টা দাড়াচ্ছে কি? নারী এবং পুরুষ আমরা কি পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে পারছি? পরস্পরের জন্য পরস্পর নিরাপদ? কেউ কিন্তু কারো জন্য নিরাপদ নয়। সকল শ্রেণিতে ঘরে ঘরে যেমন নারী নির্যাতন হচ্ছে, ঠিক ঘরে ঘরে কিন্তু পুরুষ নির্যাতনও হচ্ছে। যে গল্পগুলো আমরা শুনতে চাই না বা উপেক্ষা করে যাই। তারপর বিংশ শতাব্দীর ষাট, সত্তর এবং আশির দশকে যদি দেখি কিংবা নব্বইয়ের দশকেও আমি নিজে একাএকা রাতে নারায়নগঞ্জ থেকে সাড়ে দশটার ট্রেন ধরে ঢাকায় এসে নামতাম। তখন বাস ছিলো না। জরুরি পারিবারিক কাজে আমাকে সন্ধ্যায় যাতায়াত করতে হতো। অনেক সময় আসতে আসতে সাড়ে ১২টা বেজে যেত। বাসের কন্ট্রাক্টর, ড্রাইভার ওরা কিন্তু আমাকে নামিয়ে দিত— “হেরে নামাইয়া দেন, ঠিকমতো হেরে নামাইয়া দেন।” আমি জানতাম যে, বাসের চালক এবং কন্ট্রাক্টর আছে, আমি অনিরাপদ নই। যাত্রীদের কাছে আমি অনিরাপদ হতেই পারি। এই যে সম্মান, এই যে রক্ষা করার প্রবণতা সামাজিকভাবে ছিলো বা ট্রেনে করে যখন আমি আসতাম অন্য যাত্রীদের সঙ্গে চলে আসতাম, বুঝতে পারতাম যে তখন কত যাত্রী লক্ষ করছেন একটি মেয়ে একা যাচ্ছেন। সে নিরাপদ আছে কিনা সেটা খেয়াল করা। দুষ্টু যে তখনো ছিলো না তা নয়। কিন্তু বড় অংশটা কিন্তু ওই মেয়েটি যাতে বিপন্ন না হয় সেদিকে খেয়াল করতো। এখন কি বাসে কোনো মেয়ে যাত্রী হিসেবে নিরাপদ? আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, অঘটনগুলো বাসেই ঘটছে। ট্রেনে নিরাপদ নয়, হেঁটে নিরাপদ নয়, কর্মস্থলে নিরাপদ নয়, পথে নিরাপদ নয়। নানানভাবে পুরুষ যেমনভাবে আক্রান্ত হচ্ছে নারীও তেমনিভাবে। তারপর এটা একটা প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার হয়ে গেছে যে, ধর্ষণ করো, মেরে ফেলো, তোমার বিচার হবে না। মানে কোনো শাস্তি বা কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই। এবং অন্যায়ের প্রতি বিধানের যে বিধিটা ছিলো সে বিধিটা ধ্বংস হয়ে গেছে। এবং কেন্দ্রটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে। তাহলে যে প্রগতিশীলতা বা মুক্তি, নারী এবং পুরুষের পারস্পরিক সম্মান, বিশ্বাস করা, ভরসা করা এগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার মধ্যে যে অগ্রসরতা, তা নিয়ে আমি সন্দিহান এবং আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন।

 

জাগরণ: বাংলা সাহিত্যে নারীর অবস্থান নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

রহমান: বাংলা সাহিত্যের গোঁড়া থেকেই পুরুষের পাশাপাশি নারী আছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কথাসাহিত্যিক এবং যিনি কবিও— স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি ১৮৭১ বা ৭২/৭৩-এর দিকে সাহিত্য রচনা শুরু করেছেন এবং যশ লাভ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু তার সমকালীন দুটো উপন্যাস ছাড়া বাস্তব জীবনের গল্প বলেননি। তিনি রোমান্স রচনা করেছেন। তাকে রাজা, বাদশা প্রাচীনবিদদের কথা বলতে হয় এবং তিনি সেই পথেই গেছেন। তিনি যে “বিষবৃক্ষ” বা “কৃষ্ণকান্তের উইল” রচনা করেছেন, সেখানে সাধারণ মানুষের  না। তারা হচ্ছে অতি ধনশালী জমিদার। এবং তাদের জীবনে প্রণয় সংকট এবং কিভাবে বিপর্যয় আসে সেটা বলে গেছে। যেহেতু বঙ্কিমের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের যাত্রা শুরু তার পাশাপাশি আমাদের স্বর্ণকুমারী দেবী, রবীন্দ্রনাথে জ্যেষ্ঠ ভগিনী, তিনিও রোমান্স লেখার চেষ্টা করেছেন কিন্তু সেখানে তিনি খুব সাফল্য অর্জন করেছেন বলবো না। তিনি সফল হয়েছেন তার সমকালীন মানব বাস্তবতার গল্প যেখানে বলেছেন সেখানে তিনি অতুল্য এবং সেখানে ১৯৩০ সালে যে উত্তর আধুনিকতা এনেছেন বুদ্ধদেব বসু বা অন্যরা। সে আধুনিকতার সূত্রপাত কিন্তু  ঊনবিংশ শতাব্দির সত্তরের দশকের স্বর্ণকুমারী দেবী তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন তার উপন্যাস ‘কাহাকে’ দিয়ে। যেখানে তিনি প্রথম দেখিয়েছেন যে, পুরুষই শুধুমাত্র প্রেমের সংকটে এবং বহু মানুষের প্রেমের সংকটে ভোগে না, একটি নারীও এরকম বহুজনের প্রেমে পড়তে পারে এবং পাশাপাশি প্রেমে পড়তে পারে। এত আধুনিকতা সে ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে (ধরুন তিয়াত্তর সালে বেরিয়েছে) ‘কাহাকে’ উপন্যাস। সে ছাড়াও কিন্তু রবীন্দ্রনাথেরও আগে আধুনিক বা চিরকালীন মানুষের মনস্তাত্বিক সংকট রূপায়িত হওয়া শুরু হয়ে গেছে বাংলা সাহিত্যে। এবং অত্যন্ত সফল একটি উপন্যাস তিনি রচনা করেছিলেন। এমন না যে এ উপন্যাসের কাহিনি বিন্যাস ঘটেনি, চরিত্রটি রূপান্তরিত হয়নি, এমন না যে চরিত্রটি বিকশিত হয়নি। এমন না যে, চরিত্রটি অনিশ্চিত এবং অমিমাংসার মধ্যে ধুকছে। অমিমাংসায় আক্রান্ত আছে এই অর্থে যে সে কিন্তু বুঝতে পারছে না সে কাকে ভালোবাসে। তার এক্সকে ভালোলাগে না ওয়াইকে ভালো লাগে, না জেডকে ভালো লাগে। আবার এ-কে ভালো লাগে আবার বি-কেও ভালো লাগে। মানে প্রত্যেকের গুণের প্রতি তার এক অপরূপ গোপন মুগ্ধতা থাকছে। যে মুগ্ধতা কিন্তু আরো প্রায় একশ ব্ছর পরে অচিন্ত্যকুমার গুপ্ত এনেছিলেন বলে গালি খেয়ে বেঁচে গেছেন। সে আধুনিকতার সূত্রপাত হচ্ছেন কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবী। এবং আমি বলবো যে তিনি খুব বলিষ্ঠ এবং শিল্পসম্মত গল্প বলে গেছেন, খুবই উৎকৃষ্টমানের গল্প বলেছেন। এবং তাকে স্পর্শ করা পরবর্তী শতাব্দীতে বহু নারী লেখকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এখনতো প্রায় আমরা ভুলেই গেছি তাকে, মনেও করি না, পাঠও করিনা বা তার কাছে যে যাওয়ার দরকার সেটা আমরা মনে করছি না।

তারপর বিংশ শতাব্দী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তার যে “পদ্মরাগ” উপন্যাসটি সুবর্ণিত, সুলিখিত এবং সুনির্মিত উপন্যাস। সেখানে যে চরিত্রটি আছে তার যে বলিষ্ঠতা, তার তার যে মানবিক দায়বোধ এবং ন্যায়-অন্যায়ের বোধ এবং তার যে রক্তক্ষরণ তার কিছুই নায়ক আলমাস কবিরের (উপন্যাসের নায়ক) মধ্যে নাই। তারপরও কিন্তু সিদ্দিকের মধ্য দিয়ে নারীর একাকীত্ম এবং নারীর মানবিকতার গভীরতাটিকে তুলে ধরেছেন বেগম রোকেয়া ঔপন্যাসিক হিসেবে। এখানে আমরা দেখবো, ঔপন্যাসিক রোকেয়াকেও সেভাবে আমরা মূল্যায়ন করিনি যে তিনি কতো ভালো গল্প বলতে পারতেন।

জাগরণ: পুরুষ লেখকদের চোখে নারী চরিত্রগুলো নিয়ে একটু বলবেন।

রহমান: সাম্প্রতিককালে কথা যদি বলি, মাহমুদুল হক আমার খুব প্রিয় লেখক, তারপর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ মুজতবা আলী। এরা তো আমাদের মহীরুহ। সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর গল্প বলার যে নির্লিপ্তি এবং নিরাসক্ত প্রবণতাটি আমি ভীষণ পছন্দ করি। তাঁর “লালসালু”, “কাঁদো নদী কাঁদো” এবং “চাঁদের অমাবস্যা।” এই তিনটিতে পুরুষের প্রবল উত্থান এবং পতন এবং মানসিক পীড়নের এবং অমিমাংসার ভেতরে দেখা যায়।

‘লালসালু’তে দুটি নারীকে দেখা যায়, একটি নারী খুব প্রতিবাদ করলো একটি পা লাগিয়ে। এটা আমার কাছে কোনো প্রতিবাদ মনে হয় নাই। অবস্থাক্রমে কী ঘটতে পারে সেটাই দেখিয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সেখানে। তার মানে দুটি নারীর শরীর দেখা যায়, নারীগুলো হচ্ছে কম্পমান এবং মৌন এবং কণ্ঠস্বরহীন। ‘কাঁদে নদী কাঁদো’ বা ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় তো নারী খুনই হয়ে গেলো উপন্যাসের শুরুতে। আর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’তো দেখা যায় নারী শুধু হাঁটে ছায়ার মতো। সে পৃথিবীতে নারীরা দেখা যায় যেখানে তাদের কোনো কণ্ঠস্বর নেই, তাদের কোনো ভূমিকা নেই, তাদের কোনো জীবন নেই এবং তারা সেখানেই আছে ছায়ার অধিক ছাড়া আরো ছায়া হয়ে।

আর মাহমুদুল হকের যে “জীবন আমার বোনের” বোনটিকে আমাদের এতো ভালো লাগে কেন? কারণ, সে ভঙ্গুর, একটা টিংটিংয়ে ফড়িং। তাকে বুকের ভেতরে আগলে রাখতে হয়। এবং তার ভাইটিই হচ্ছে সর্বশক্তিমান এবং পতনে-উত্থানে তারই সবকিছু করার আছে। টিংটিংয়ে হরিণটিতে সহানুভূতি, মমতা, কান্না এবং করুণা দিয়ে দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। তার মানে কী দাড়াচ্ছে? ভঙ্গুর হলে তার প্রশংসাকীর্তন করা যায়, এইতো।

জাগরণ: নারী লেখকদের চোখে পুরুষ চরিত্রগুলো নিয়ে আপনার মূল্যায়ন শুনতে চাই।

রহমান: তাহলে আমি দুইজন নারী লেখকের কাছে যাচ্ছি। রাজিয়া খান আমিন এবং রাবেয়া খাতুন। রাজিয়া খান আমিনের কথাই বলি, স্বর্ণকুমারীর পরে আমাদের যে উপন্যাসটি মাইলফলক হয়ে আছে— “বটতলার উপন্যাস।” সেখানে দুটি নারীর চরিত্র আছে সুমিত্রা চরিত্রের কথা যদি বলি। সুমিত্রা মোহিনকে ভালোবাসে এবং সুমিত্রা অপেক্ষা করে, মোহিন গুছিয়ে উঠতে পারে না, ইন্ডিয়া-পাকিস্তান তখন বিভাজনটা হয়েছে। সুমিত্রার পক্ষে কিভাবে আসা সম্ভব, ধর্মান্তরিত হবে নাকি মোহিন কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেবে? অপেক্ষায় রাখে। মোহিন অন্য মেয়েকে বিয়ে করে তাকে উদ্ধার করে, তারপর আরো আরো কাজ করে, সুমিত্রা কিন্তু মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যায় এবং সত্যিকারার্থেই পাগলের মতো হয়ে যায়। চিকিৎসা শুরু হয়ে যায়। এর সঙ্গে আরেকটি পার্শ্বচরিত্রও আছে, যে মেয়েটি আত্মহত্যা করে। তার স্বামীটির কাছে সেই আশ্রয়টুকু পায় না যা দিয়ে সে বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

জাগরণ: আপনার একটি লেখায় বলেছেন, পৃথিবীতে যদি প্রকৃতি বা রাজনীতি বা সমাজনীতি পড়ার বিষয় হয়, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠের বিষয় হলো পুরুষ। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন।

রহমান: আজ থেকে ৭ হাজার খ্রিস্টপূর্বে মেসোপটেমিয়ার যে গিলগামেশের যুদ্ধের কাহিনীটা পাওয়া গেছে সেখান থেকে এ পর্যন্ত এসে যত পুরুষ লেখকেরা লিখেছেন, সকলে কিন্তু বলে গেছেন— নারী হচ্ছে রহস্যময়, নারী হচ্ছে দানবী, দেবতাও তার চরিত্র বুঝতে পারে না, নারী অন্ধকারে আসে, “বলেছে সে এতদিন কোথায় ছিলেন” বলে চলে যায়। নিজের মনের মতো করে নারীদের গড়ে রেখেছেন। আমি যখন লেখা শুরু করলাম, আমি তো ভীষণ রকমের পুরাণবেষ্টিত ও মিথোলজিবেষ্টিত মানুষ। মিথোলজি পড়তে পড়তে আমি দেখলাম যে, আশপাশে যে আমার সহপাঠীদের দেখলাম, রাস্তায় চলা মানুষদের দেখলাম, আত্মীয়স্বজনদের দেখলাম এবং দেখলাম যে, প্রকৃতির ভেতরে যেমন বৈচিত্র আছে, ঋতুবদল ঘটে এবং ফুল ফলায়, গাছ পড়ে যায়। সমাজে যত জটিলতা আছে, যতে তত্ত্ব আছে ঠিক একরকমই তাত্ত্বিকভাবে, অতাত্ত্বিকভাবে পঠনযোগ্য আরেকটি বিষয় রয়ে গেছে যেটি কেউ পাঠ করছে না। আমাদের অধিকাংশ সাম্প্রতিক নারী লেখকও যারা অনেকে বেশ নামও করেছেন তারাও পুরুষ-ভাবনার ছকে পুরুষকে গড়ে তোলে। পুরুষ লেখকের পুরুষকেই আমি নারী লেখকের পুরুষের ভেতর পাচ্ছি। এমন নয় যে, নারী লেখকের উপন্যাসে পুরুষকে ভিলেন বানিয়ে তুলতে হবে। নারী পুরুষকে কিভাবে দেখছেন এই দেখাটাই মেইন।

আমি যা দেখতে পাচ্ছি, সাবলীলভাবে সামাজিক বাস্তবতায় কদমে কদমে চলে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে, লেখক সতীর্থ হিসেবে পেয়ে সবকিছুতেই দেখছে এর যে সৌন্দর্য, অসৌন্দর্য্য এর যে হীনতা, এর যে অসহায়তা, এর যে মহৎ হওয়ার বাসনাটা, এর যে আকাঙ্ক্ষা, এর যে নির্দয়তা, এর বলতে আমি পুরুষকে বোঝাচ্ছি, পুরো বিষয়টা আমাদের পৃথিবী যেমন যতটা বড়, পুরুষের এই পৃথিবীটাও ততোটাই বড় এবং সেটা সম্পূর্ণ অনালোচিত থেকে যাচ্ছে। আর পুরুষ লেখকরা যে পুরুষকে বুঝছেন সেটাও কিন্ত একটা ছক ধরে। যে তাকে এতখানি বড় দেখাতে হবে, ভিলেন দেখাতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তার বাইরে যে মানুষ পুরুষের যে সংকট, তার যে কান্না, তার যে ক্রোধ, তার যে হীনতা, তার যে ভালো হয়ে উঠার স্বপ্ন, আকুলতা, এ সমস্ত বিষয়গুলোকে সত্যিকারার্থেই তুলে ধরাও হয়নি, পাঠ করাও হয়নি, তার দিকে তাকানোও হয়নি। ফলে আমার যেটা মনে হয়েছে এমন একটা বিষয় আলোহীন পড়ে থাকছে এটাতো খুব অন্যায়। ফলে এতটা পথ জুড়ে যা দেখছি যা খুব চাঞ্চল্যকর এবং সত্যি চাঞ্চল্যকর মনে করি।

জাগরণ: আপনার নিরন্তর পুরুষ ভাবনাটি কেমন?

রহমান: আমার নিরন্তন পুরুষ ভাবনা হচ্ছে আমি চিরকাল ধরে বিশ্বাস করি, অনুশীলন করি যে পুরুষ হচ্ছে নারীর বিপরীত এবং পরিপূরক একটি সত্ত্বা। কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বী না।কেউ কারো শত্রু নয়, এরা হচ্ছে পরিপূরক। এবং এরা পরস্পরের হাত ধরে থাকে বলেই সভ্যতা এগিয়েছে। সে গুহুাবাসীর জীবন থেকে ক্রমাগত কৃষিজীবী জীবনে আসছে এবং তারপর অগ্রসরতা এসেছে। এতো এতো অতিমারী, মহামারী, যুদ্ধ, রক্তপাত, প্রলয়, ধ্বংসের পরও যে আবার আমরা অগ্রসর হয়েছি সেটা হচ্ছে পুরপূরক এবং বিপরীত সত্ত্বাটির জন্য। পরস্পর পরস্পরের জন্য কল্যাণকর, পরস্পর পরস্পরের আশ্রয় এবং গন্তব্য। আমি তো সে পুরুষেরই স্বপ্ন দেখেই গেলাম এবং অপেক্ষায় থাকলাম।

জাগরণ: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশে নারীর স্বাধীনতা কতখানি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

রহমান: আমি বলবো যে ব্যাপকভাবে নারী শিক্ষিত হচ্ছে, ব্যাপকভাবে নারী পদস্থ হচ্ছে, ব্যাপবভাবে নারী নানা কাজে তার পদচিহ্ন রেখে চলছে। আমাদের পরিবারগুলোতে যেটি আমি লক্ষ্য করেছি, আমি তো পড়াই সেক্ষেত্রে আমি একদম নবীনদের দেখতে পাচ্ছি। আগে ঘরে ঘরে মায়েরা এত শিক্ষিত ছিলো না, তারা যেটা করতেন, মৌলিক শিক্ষাটা ছেলেমেয়েকে দিতেন। বাইরে মেয়েদের বা নারীদের এরকম চোখে দেখতে হবে, নয় তো তোমার কিন্তু শাস্তি হবে। একটা ধর্মবোধ, জবাবদিহিতার শিক্ষা নিয়ে কিন্তু বড় হতো। এই যে মৌলিক শিষ্টাচারটা কিন্তু সমাজ থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। মানুষকে যে শ্রদ্ধা করতে হবে, বয়োজ্যোষ্ঠদের প্রতি আমার যে দায়িত্ব আছে এবং স্ত্রীদের বিশেষ করে সে কারো না কারো বোন, স্ত্রী, মা বা কন্যা। তার নিরাপত্তা যেন প্রাকৃতিক নিয়মে থাকে, এ শিষ্টাচার লুপ্ত হয়ে গেছে একেবারে সমস্ত পর্যায় থেকে।