• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০১৯, ০৯:৫২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ৩১, ২০১৯, ১০:০২ পিএম

অভিযুক্তকে অপরাধী বলা যাবে না

‘আদেশ সরাসরি দিলে ভালো হতো’

‘আদেশ সরাসরি দিলে ভালো হতো’

র‍্যাপিড একশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) ওয়েবসাইটে গণমাধ্যমের জন্য দেয়া প্রেস রিলিজ অপশনে চলতি আগস্ট মাসে ৮ জনকে গ্রেফতারের খবর দেয়া আছে। চারটি আলাদা প্রেস রিলিজে তাদের সবাইকে ‘মাদক ব্যাবসায়ী’ হিসেবে পরিচিতি লেখা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় এই চিত্র দেখা যায়।

চারটি প্রেস রিলিজেরই শিরোনামে গ্রেফতারকৃতদের ‘মাদক ব্যবসায়ী’ বা ‘মাদক কারবারী’ বলে উল্লেখ করা হলেও সবগুলোরই বিবরণের শেষ বাক্যে বলা হয়েছে, উপরোক্ত বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা ‘প্রক্রিয়াধীন’। অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়াধীন থাকাবস্থাতেই আটককৃতদের মাদক ব্যবসায়ী বলে তাদের পরিচয় তুলে ধরেছে র‍্যাব।

র‌্যাবের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া একটি প্রেস রিলিজের ছবি

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আটক আসামিকে ‘শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ২৮ আগস্ট টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার (এসপি) সঞ্জিত কুমার রায়ের SP Tangail নামের ফেসবুক একাউন্ট থেকে ছবিসহ একটি পোস্ট দেয়া হয়। শুক্রবার (৩০ আগস্ট) রাতে এতে লেখা দেখা যায়, ‘জেলা গোয়েন্দা শাখা ডিবি (দক্ষিণ), টাঙ্গাইল কর্তৃক ৪০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট সহ ০২ জন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার।’

SP Tangail নামের ফেসবুক একাউন্ট থেকে ছবিসহ এই পোস্ট দেয়া হয়েছে    - ছবি : ফেসবুক থেকে নেয়া

তদন্ত বা বিচার পর্যায়ে গণমাধ্যমে এমনভাবে বক্তব্য দেয়া যাবে না যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী। গত বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) একটি রায়ে হাইকোর্টের দেয়া এ সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের পরও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুলিশ-র‍্যাবের এই চিত্র অব্যাহত থাকে।

আইনজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রে সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আর কেউ বলছেন, আদেশ সরাসরি দিলে ভালো হতো।

জানতে চাইলে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমান আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক দৈনিক জাগরণকে বলেন, ‘রায়টি না পড়ে তো কিছু বলতে পারছি না। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে এটি বলতে পারি যে, এ ধরনের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে এবং তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘মনে রাখতে হবে অন্যান্যের মতো একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিরও সমাজে, সংসারে, ছেলে-মেয়ের কাছে সম্মান আছে। মিডিয়া ট্রায়াল যেন না হয়ে যায়, সেই বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি তো বিচার শেষে খালাসও পেতে পারেন। এক আদালতে দণ্ডিত হয়ে উপরের আদালতে গিয়েও খালাস পেতে পারেন।’

এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বহুল আলোচিত শারমিন রীমা হত্যার ঘটনার মামলার উদাহরণ দেন। ১৯৮৯ সালের ৮ এপ্রিলের ওই ঘটনায় খ্যাতনামা ডাক্তার বাবা-মায়ের ব্যবসায়ী ছেলে মুনির হোসেন তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রী শারমিন রীমাকে হত্যা করেন। মনির হোসেনের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে সংঘটিত হয় ওই হত্যাকাণ্ড। দীর্ঘদিন মামলা চলার পরে নিম্ন আদালতে মুনির হোসেন এবং হত্যাকাণ্ডে প্ররোচনাদানকারী তার প্রেমিকা হোসনে আরা খুকুর ফাঁসির রায় হলেও উচ্চ আদালতের রায়ে খুকুকে খালাস দেয়া হয়।

গত ২৯ আগস্ট হাইকোর্টের দেয়া এ সংক্রান্ত রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আদালতে কারও অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগে তাকে অপরাধী বলা বেআইনি।’ জনস্বার্থে করা বহুল আলোচিত বহু মামলার এই আইনজীবী অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘এই বেআইনি চর্চা না করার জন্য আদালত আগে-পরে আরও আরও বলেছে। কিন্তু এই চর্চা তো চলছেই। এবারের আদেশটি সরাসরি দিলে ভালো হতো। কারণ সরাসরি আদেশ না দিলে তা কতখানি কার্যকর হবে, বলা মুশকিল।’

প্রসঙ্গত, গত ২৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, মামলার তদন্ত পর্যায়ে তদন্তের অগ্রগতি বা গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির বিষয়ে গণমাধ্যমকে কতটুকু জানানো যাবে, সেই বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন বাঞ্ছনীয়। এই নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বরগুনার সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকার জামিনের রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট এই নির্দেশ দেন।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, আসামি আয়শা সিদ্দিকা রিমান্ডে থাকাকালে বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন গণমাধ্যমে আয়শা দোষ স্বীকার করেছেন বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা শুধু অযাচিত, অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, ন্যায়নীতি ও সুষ্ঠু তদন্তের পরিপন্থী। পরিস্থিতি ও বাস্তবতা যা-ই হোক না কেন, কোনো পুলিশ সুপার দায়িত্বশীল পদে থেকে এমন ধরনের বক্তব্য দিলে, তা জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। সেই সঙ্গে তিনি তার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেননি, যা দুঃখজনক ও হতাশাজনক। উচ্চপর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশিত ও কাম্য নয়। দায়িত্ব পালনে এরপর থেকে তিনি সতর্কতা ও পেশাদার মনোভাবের পরিচয় দেবেন এটাই আদালতের অনুরোধ। মামলার কাজ এখনো চলমান। সেই কারণে এ বিষয়ে এই মুহূর্তে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া হচ্ছে না। তবে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেন, আজকাল দেখা যাচ্ছে যে, কোনো আলোচিত ঘটনার তদন্ত চলমান থাকলেও পুলিশ-র‍্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি, অভিযুক্ত বিষয় বা তদন্ত সম্পর্কে প্রেস বিফ্রিং করছে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি, সন্দেহভাজন বা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয়। অনেক কর্মকর্তাকে অতি উৎসাহ নিয়ে তদন্ত চলছে— এমন বিষয়ে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। এসব বিষয় অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। এ বিষয়ে আদালতের একটি রায়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।

আদালত বলেন, এ কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বলা যাবে না যে, তিনি অপরাধী বা অপরাধ করেছেন। তদন্ত বা বিচার পর্যায়ে গণমাধ্যমে এমনভাবে বক্তব্য দেয়া যাবে না যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী। মামলার তদন্ত পর্যায়ে, তদন্তের অগ্রগতি বা গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে গণমাধ্যমকে কতটুকু জানানো যাবে, সেই বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা বাঞ্ছনীয়।

এমএ/ এফসি

আরও পড়ুন