• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০১৯, ০৬:৫২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১৭, ২০১৯, ০৬:৫৩ পিএম

নিঃসঙ্গ প্রবীণ জীবন হোক আলোময় 

নিঃসঙ্গ প্রবীণ জীবন হোক আলোময় 

 বাবা-মা বিশ্বের সবচে আপন মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম। জন্মের আগে থেকে মা আর জন্মের পর থেকে বাবা-মা দুজনই সন্তানের ছায়ায় পরিণত হয়। তার সন্তানকে নিয়ে গড়ে ওঠে তার ভাবনার জগত।  শাসন আর স্নেহের যৌথ বেড়াজালে সন্তানকে শেখান আগামীর পথ চলার সব মন্ত্র। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা শিখানো সম্ভব না সেটা শেখান বাবা - মা।  সব  ঝড় আর ঝঞ্ঝাট থেকে সন্তানকে আগলে রাখেন বাবা। সেন্তান একবেলা না খেলে বাবা- মা দুজনের ঘুম বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু  বাবা-মা বৃদ্ধ হলে কেমন থাকেন তারা?

বাবা-মার হাত বড্ড বেশি নির্ভরতার। কখনো সবুজাভ উর্বর ফসলী জমিন, আবার কখনো দুহাত ছড়ানো উদার আকাশ। তার সুবিশাল ছায়ায় বেড়ে উঠে সন্তান, তৈরি হয় বর্তমান আর ভবিষ্যতের পথ চলার মসৃণ রাজপথ।জীবনের নানা মোড় পেরিয়ে এই বাবাও এক সময় হয়ে পড়েন নিঃসঙ্গ সারথি। জীবন, জীবিকা কিংবা সাংসারিক নানা জটিলতায় দূরে যেতে যেতে সন্তান চলে যায় বহুদূর। অপেক্ষার অষ্টপ্রহর জুড়ে তখন শুধু সন্তানের স্মৃতির আনাগোনা। নেপথ্যে বাজে দীর্ঘশ্বাসের সাতকাহন। আগারগাঁও বৃদ্ধাশ্রমে থাকা একজন বাবা রহমত আলী  বলেন, আমার এক ছেলেকে পড়িয়েছি , পেনশনের ডাকা দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে পিএইচডি করিয়েছি। কিন্তু একবার দেখতেও আসে না । দুই মেয়ে তারাও দেশেই থাকে।  তারা কেউই আমার খোঁজ নেন না। ভেবেছিলাম এই ঈদে নিতে আসবে। কেউ আসেনি। বলে হাইমাউ করে কাঁদতে থাকেন তিনি। এসব যেসব বাবা- মাদের গল্প, তাদের জীবনের কঠিন বাস্তবতার সমীকরণ থেকে যায় আফসোসের বৃত্তেই।


বাবা-মা হোক বৃদ্ধ, তবু তারা প্রনম্য।  জীবনের নানা চড়াই - উতরাই পার করে তারা সন্তানদের বড় করা সর্বোপরি তাদের প্রতিষ্ঠিত করাটাকে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মনে করেন। জীবনের সব অর্জন দিয়ে দেন সন্তানকে। বৃদ্ধ হলে সেই সন্তান যখোন বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসেন তখন করার  কিছুই থাকেনা। দিন কত বদলে গেছে ভাবা যাবে না। মানুষ বড় স্বার্থপর বড় অকৃতজ্ঞ হয়ে যাচ্ছে। এখন আর ছেলেমেয়ের ঘরেও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের  স্থান হয় না।  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি দেশের,  শিক্ষা-সংস্কৃতি, মানবিকবোধ  নিজস্ব রূপ পায়। সেই নিজস্ব রূপের এক রূঢ় বাস্তবতার নাম। বর্তমান সময়ে বৃদ্ধাশ্রমও তেমনি এক বাস্তবতা। বৃদ্ধবাবা-মা কে বনবাস দেয়ার মতো আশ্রমে পাঠিয়ে দেয়াটা আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না। তারপরও ঢাকায় বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা। বৃদ্ধা মা প্রীতি রানী জানান, তাকে তার ছেলে এখানে এনেছিলো চিকিৎসার কথা বলে। তারপরে আর আসেনি। এই তিন বছর হলো। তবুও কেউ আসলে গেট খোলার শব্দ পাই ভাবি ওরা এলো বুঝি। কেউ আসে না। প্রতিদিনের শুরু হয় ভোরে ঘুম থেকে উছঠ সবাই দল বেধে হাঁটেন।

তারপর বিশ্রাম নিয়ে নাস্তা। গল্প করেন সবাই। কিন্তু গল্প করে কতদিন বাঁচা যায়। আমাদের এখনতো নতুন গল্প তৈরি হয় না। একই কথা বার বার বলতে বা শুনতে কার ভালো লাগে বলেন আয়েশা বেগম।কী করলে এ আশ্রয়গুলোকে আরও সুখের আবাস রূপে গড়ে তোলা যায় সেই পরিকল্পনা কতরা উচিৎ। নতুবা জীবন কাটে না, জীবনী শক্তিও কমে আসে।  বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জীবন আনন্দময় না করলে এখানেআসা মানেই মৃত্যুর সাথে বসবাস করছি বলে মনে হয়। যেমন আশ্রমগুলোর সামনে উন্মুক্ত খেলার মাঠ থাকলে কোলাহলময় একটা পরিবেশ তৈরি হয়। বিকেলে বাচ্চাদের দুরন্তপনা দেখে হারিয়ে যেতে পারেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। ওদের মাঝে নাতি-নাতনির ছায়া পেতে পারেন তারা। আশ্রমের ভেতরে বা বাহিরে সব্জি বা ফুলের বাগান থাকলে কেউ কেউ গাছের পরিচর্যা করেও সময় কাটাতে পারেন। একটা লাইব্রেরি থাকলে যাদের বই পড়ার অভ্যাস আছে তারা সেভাবে সময় কাটাতে পারেন। বিনোদনের জন্য টেলিভিশনের ব্যবস্থা থাকতে পারে। প্রশিক্ষকদ্বারা হালকা কাজের আয়োজন করা হয় তাদের জন্য মাঝে মাঝে পিকনিকের মতো দূরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা গেলে এসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মন ফুরফুরে আর সতেজ থাকবে।

সকাল বিকেল খোলা মাঠে বা রাস্তায় হাঁটা যা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা থাকা চাই এখানে। এছাড়াও সেবা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে। যারা তুলনামুলক বেশি বয়ষ্ক তাদের কাছে সার্বক্ষণিক একজন সেবিকা থাকা খুবই প্রয়োজন। তাদের জন্য বিশেষ যত্নের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কারণ বৃদ্ধাশ্রম একটি সেবা প্রতিষ্ঠান। সরকার এবং ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে ওঠা আশ্রমগুলো সমাজের মানুষের অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করেই কিন্তু গড়ে তোলা হয়। আবার পরিস্থিতির কারণে আত্মীয়স্বজনেরা যাদের আশ্রমে পাঠাচ্ছেন, তাদেরও উচিত বিভিন্ন সময়ে বা কোন উৎসবে তাদের হাত খরচ দেয়া, দেখতে যাওয়া কিংবা বাসায় নিয়ে আসা। ইচ্ছে হলে কিছুদিনের জন্য সন্তান বা আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে যাওয়া আাসার মাধ্যমে পারস্পরিক একটা স্বাধীন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ থাকলে তাদের মনোকষ্ট অনেকাংশে কম হবে আশা করা যায়। আবার তাদেরই যে শুধু আত্মীয় স্বজনদেরই দেখতে যেতে হবে, এমনও নয়। ছুটির দিনগুলোতে যে কেউই বাচ্চাদের নিয়ে মাঝে মধ্যে বৃদ্ধাশ্রমেও বেড়াতে যেতে পারেন। এতে সেখানে থাকা বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের যেমন ভালো লাগবে, তেমনি মানুষের সঙ্গে মানুষের সৌহার্দ্য হৃদ্যতাও বৃদ্ধি পাবে এবং তা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মানবীয় গুণসম্পন্ন মানুষরূপে বড় হতে সাহায্য করবে। কারন আজ আমরা যারা কর্মক্ষম দাপুটে মানুষ আগামীকাল আমাদের পরিনতিও কিন্তু এ রকমই হবে। আর এই পরিণতি এক সময় হয়তো সহজভাবেই নেবে সবাই। তবু বর্তমান সময়ে বাবা-মার জায়গা যাতে বৃদ্ধাশ্রমের নিঃসঙ্গ জীবন না হয় সেই মানবিকবোধ বৃদ্ধি করতে হবে।