• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২১, ০৯:৩৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২১, ০১:২৬ পিএম

অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পাঠ

অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পাঠ

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে, বাড়িয়ে বললে রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির ইতিহাসে ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ বেশ কুখ্যাত। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা নিয়েই অ্যালান জে পাকুলা ছবি বানালেন ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’ (১৯৭৬)। মুক্তির পর ছবিটি অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব ও বাফটার মতো পাটাতনে একাধিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, ২০১০ সালে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ছবিটিকে ‘সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও নান্দনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ উল্লেখ করে জাতীয় চলচ্চিত্র মহাফেজখানায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় দেশটির কেন্দ্রীয় পাঠাগার।

প্রশ্ন হলো, ছবিটিকে কেন জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলা হলো? এর কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে দুটি। প্রথমত, এই ছবি নির্ভীক, স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কথা বলেছে, বলেছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদপত্রের ক্ষমতার কথা। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে সাংবাদিকদের যে একাগ্রতা ও আপসহীন মানসিকতা এখানে দেখানো হয়েছে, তা যেকোনো সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষণীয়। দ্বিতীয় কারণ হলো, মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্যের দিকটি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকেও, অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়া। এবার পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ছবির কাহিনি কী আসলে?

অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন ছবির একটি দৃশ্য

সংক্ষেপে যদি বলি, ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সের ভেতরে ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় কমিটির কার্যালয়ে পাঁচজন লোক ধরা পড়ল মাঝরাতে। এটি ১৯৭২ সালের ১৭ জুনের ঘটনা।  প্রথমে সবাই ভাবল এটা নেহাত চুরি বা ডাকাতির ঘটনা। ওয়াশিংটন পোস্ট তাই নতুন এক প্রতিবেদককে স্থানীয় আদালতে পাঠাল ঘটনাটি জেনে আসার জন্য। প্রতিবেদকের নাম বব উডওয়ার্ড (রবার্ট রেডফোর্ড)। বব আদালতে গিয়ে জানলেন পাঁচজনের চারজন মিয়ামির লোক, কিউবান-আমেরিকান এবং পঞ্চমজন জেমস ম্যাককর্ড, এই ম্যাককর্ড সদ্য সিআইএ ছেড়েছেন। অন্যরাও কোনো না কোনোভাবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। তারা ডেমোক্র্যাটদের অফিসে গিয়েছিলেন আড়িপাতার যন্ত্র বসানোর জন্য। রিপোর্টার বব আশ্চর্য হন আদালতে এই পাঁচজনের জন্য আসা নামীদামি এক আইনজীবীকে দেখে। সন্দেহ এখান থেকে ঘনীভূত হতে থাকে।

বব ধীরে ধীরে আবিষ্কার করেন এই পাঁচজনের সঙ্গে যোগসূত্র আছে সিআইএ ও হোয়াইট হাউসের হোমরা-চোমরাদের। যাদেরকে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ধরা হয়। ববের এই অনুসন্ধানের সারথি হয় আরেক প্রতিবেদক কার্ল বার্নস্টেইন (ডাস্টিন হফম্যান)। রাতদিন খাটাখাটনি করে, গোয়েন্দাদের মতো লেগে থেকে এই দুজন অনেক তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করেন এবং সম্পাদককে রাজি করান কাগজের প্রথম পাতায় ওয়াটারগেট সম্পর্কিত খবরটি ছাপাতে। খবরটি ছাপার পর প্রতিক্রিয়া শুরু হয় সরকারি পর্যায়ে। এরপর প্রতিবেদক দুজন একাধিক প্রতিবেদনে প্রমাণ করেন গ্রেপ্তার পাঁচজনের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ গিয়েছে নিক্সনকে পুনর্নির্বাচিত করার জন্য গঠিত কমিটির গোপন তহবিল থেকে। অবশ্য এই তদন্তে ওয়াশিংটন পোস্টের দুই প্রতিবেদককে সাহায্য করেছেন পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি সূত্র। তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের কারণেই প্রমাণ হয় নির্বাচনে জেতার জন্য অবৈধভাবে আড়িপাতা হচ্ছিল প্রতিপক্ষের কার্যালয়ে।

১৯৭৩ সালের ২০ জানুয়ারি বার্নস্টেইন ও উডওয়ার্ড যখন পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি লিখছেন অফিসে বসে, তখন নিক্সন দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব পালনের জন্য শপথ গ্রহণ করছেন। চলচ্চিত্রে বিষয়টি দেখানো হয়েছে বেশ কায়দা করে। ফ্রেমের সামনের অংশে টেলিভিশন, সেখানে নিক্সনের শপথ গ্রহণ, আর পেছনে ফোকাস করা হয়েছে দুই প্রতিবেদকে, তারা টাইপরাইটারে খটাখট করে লিখে চলেছেন এমন এক প্রতিবেদন, যা পরে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। যেন টাইপরাইটারের একেকটি চাবি চাপার শব্দ শপথের একেকটি শব্দের ওপর চেপে বসছে, আর তাকে নাকচ করে দিচ্ছে। এরপর পরিচালক মন্তাজের মাধ্যমে বছরব্যাপী ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিবেদন হাজির করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে দেখানো হয় নিক্সন পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করছেন। ছবিটি শেষ হয় ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া গেরাল্ড ফোর্ডের অভিষেক অনুষ্ঠান দেখানোর মাধ্যমে।

ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদক নির্ভর করেছিলেন, আস্থা রেখেছিলেন তরুণ প্রতিবেদকদের ওপর, তিনি জানতেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে, যদি তাদের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠা না হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তারা সফল হন সত্য প্রতিষ্ঠায়। কার্ল বার্নস্টেইন ও বব উডওয়ার্ডের যৌথভাবে লেখা নন-ফিকশন ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’ বইটিকে ভিত্তি করেই তৈরি হয় চলচ্চিত্রটি। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরই এই দুই প্রতিবেদক বইটি লিখে ওঠেন।

বই বলি বা চলচ্চিত্র, নামটি কিন্তু বেশ চেনাজানা এক ইংরেজি ছড়ার সঙ্গে মিলে যায়। ছোটবেলায় পড়া ‘হাম্পটি ডাম্পটি’ ছড়াটি সবারই মুখস্থ। সেখানকার কয়েকটি লাইন এমন: “অল দ্য কিং’স হর্সেস অ্যান্ড অল দ্য কিং’স মেন/ কুডন্ট পুট হাম্পটি টুগেদার অ্যাগেইন,” অর্থাৎ যে ডিম পড়ে ভেঙে গেছে তা হাজার চেষ্টা করেও আর জোড়া লাগানো যায় না। নীতি-নৈতিকতা ডিমের মতোই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের যে নৈতিক স্খলন শুরু হয়েছিল এবং তার প্রতিক্রিয়ায় যে তার মসনদ উল্টে যাচ্ছিল, তা আর সোজা করা যায়নি। শিরোনামটি থেকে অবশ্য অন্য পাঠও নেওয়া যায়, তা হলো, যে অনৈতিক কাজটি তারা করেছেন, তারা সবাই প্রেসিডেন্টের লোক। মজার বিষয় হলো ঊনবিংশ শতকের এই ছড়াটিতে থাকা ডিমসদৃশ প্রাণী বা জীবকে নানা সময়েই ঐতিহাসিক নানা চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেকে। আদতে এটি একটি রূপকমাত্র। সেই বিচারে ডিমকে আপনি বিশ্বাসের সঙ্গেও তুলনা করতে পারেন। রাজা বিশ্বাস ভঙ্গ করলে তা আর শত চেষ্টাতেও জোড়া লাগে না।

চলচ্চিত্রটি যেভাবে তৈরি হয়েছে তাতে পরিচালকের প্রতি দর্শকের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়নি। তাই যুক্তরাষ্ট্রে তো বটেই, সারা দুনিয়াতে এই ছবিটি এখনো শক্তিশালী রাজনৈতিক থ্রিলার হিসেবে বেশ সমাদৃত। আর যারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা শিখতে চান, তাদের জন্যও অবশ্য পাঠ্য এই ছবিটি।