• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৮, ২০১৯, ১১:৩৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২৮, ২০১৯, ১১:৪৩ এএম

বাগদাদি নিউট্রালাইজড

আইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির উত্থান-পতন

আইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির উত্থান-পতন
আবু বকর আল বাগদাদি - ফাইল ছবি

সিরিয়ায় পরিচালিত মার্কিন সেনাবাহিনীর আইএস বিরোধী বিশেষ অভিযানে নিহত হয়েছেন উগ্রপন্থী সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন আইএসআইএল (ইসলামিক স্টেটস অ্যান্ড লেভান্ত)-এর প্রধান নেতা আবু বকর আল বাগদাদি। রোববার (২৭ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের উদ্দেশে দেয়া এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। 

এ প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, সিরিয়ায় বিশেষ মার্কিন টাস্কফোর্সের অভিযানে নিহত হয়েছেন বাগদাদি। শনিবার (২৬ অক্টোবর) রাতে মার্কিন বাহিনীর তাড়া খেয়ে সিরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোণঠাসা হয়ে পড়া বাগদাদি শেষ মুহূর্তে পালাবার পথ খুঁজে না পেয়ে, গ্রেফতার এড়াতে নিজের সঙ্গে থাকা সুইসাইডাল ভেস্টের বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হন। এ ঘটনার পরপরই ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বাগদাদির মৃতদেহ শনাক্ত করা হয়। রয়টার্স

এ ঘটনার পরপরই বিভিন্ন মহল থেকে বাগদাদির সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য প্রকাশ পেতে শুরু করে। যার প্রেক্ষিতে একটি প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা শুরু হয়- কে এই আবু বকর আল বাগদাদি?

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, মার্কিন ডিফেন্স ডকুমেন্টারি স্ট্যাটিক্সসহ বিভিন্ন সূত্র অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দৈনিক জাগরণের পাঠকদের জন্য আবু বকর আল বাগদাদি সম্পর্ক নানা অজানা বিষয় তুলে ধরা হলো।

|| একজন মেধাবী ও উদীয়মান তারকা ফুটবলারের উগ্রপন্থী নেতা হয়ে ওঠার কথা
স্বপ্ন ছিল বিশ্বমানের তারকা ফুটবলার হওয়ার। পড়ালেখার পাশাপাশি এক ফুটবলই ছিল তার সব। জাতীয় পর্যায়ের একজন সম্ভাবনাময় ইরাকি তারকা ফুটবলার হয়ে ওঠার পাশাপাশি উচ্চতর শিক্ষার্জনে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেন বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের মেধাবী মুখ আবু বকর আল বাগদাদি উরফে ডক্টর আবু বকর আল বাগদাদি (ডক্টরেট ইন ফিলোসফি- মডার্ন ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ)।

* প্রথম জীবন
১৯৭১ সালে ইরাকের ছোট্ট শহর সামারার একটি সুন্নি পরিবারে জন্ম হয়েছিল বাগদাদির। পারিবারিকভাবে তার নাম ছিল ইব্রাহিম আল বদরি। সাবলীল জীবনযাপনে অভ্যস্ত বাগদাদির পথচলায় আকস্মিকভাবেই আশে পরিবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ধর্মভীরু বাগদাদি জড়িয়ে পড়তে শুরু করেন মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মুসলিম ব্রাদারহুডের কার্যক্রমের সঙ্গে। ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তার। আর তাই ইসলামিক জিহাদিস্টের সক্রিয়কর্মী এক চাচার হাত ধরে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নাম লেখান বাগদাদি।

একজন মেধাবী ও শক্তিশালী সমন্বয়ক ও সংগঠকের সকল গুণই ছিলো তার। যার ফলে দ্রুতই সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের চোখে পড়েন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যেই জিহাদি সংগঠনের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বের পাশাপশি সশস্ত্র জিহাদী ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়ক হয়ে ওঠেন তিনি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইএসআইএল নেতৃবৃন্দের আস্থাভাজনে পরিণত হওয়া বাগদাদির হাত ধরেই ওসামা বিন লাদেনের আল কায়দা ও আইএসআইএস-এর মতো চরমপন্থী সংগঠনগুলোর সঙ্গে শক্ত লবিয়িং গড়ে তোলে আইএসআইএল।

পরিবারের ধর্মীয় পরিবেশ জোরালো প্রভাব ফেলেছিল বাগদাদির উপর। ছোটবেলা থেকেই কোরান ও ধর্মীয় রীতিনীতির উপর প্রতি অসম্ভব টান ছিল তার। তা নিয়েই পড়াশোনা শুরু করেন তিনি।

* আইএস প্রধান আল বাগদাদির উত্থান
মার্কিন স্পেশাল টাস্কফোর্স ইউএস মেরিন সীলের এক বিশেষ অভিযানে বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলো দুর্বল হয়ে পড়লে আবার তা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বে আসেন বাগদাদি। এরপর ২০১৩ সালে নিজেকে সংগঠনের প্রধান নেতা বা ‘খলিফা’ হিসেবে ঘোষণা করার পরই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদে উঠে আসতে শুরু করে বাগদাদির নাম। একই সঙ্গে তাকে দমনে মরিয়া হয়ে ওঠে মার্কিন সরকার। তবে দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একজন শীর্ষ জঙ্গি নেতা হিসেবে কাজ করে গেলেও তার ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য জানা ছিল না কারোই। আর যা কিছু তথ্য জানা ছিল, তাও ছিল মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতেই সীমাবদ্ধ। 

পরিবারের ধর্মীয় পরিবেশ জোরালো প্রভাব ফেলেছিল বাগদাদির উপর। ছোটবেলা থেকেই কোরান ও ধর্মীয় রীতিনীতির উপর প্রতি অসম্ভব টান ছিল তার। তা নিয়েই পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ১৯৯৬ সালে বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজের উপর ব্যাচেলর ডিগ্রি পান তিনি। এর পর কোরানিক স্টাডিজে মাস্টার ডিগ্রি ও পরে ডক্টরেটও পান তিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইল থেকে অবশ্য বাগদাদি সম্পর্কে বড়সড় তথ্য মেলেনি। জানা যায়, এই সময়েই বাগদাদ শহরের কাছে একটি মসজিদে শিশুদের কোরান শিক্ষাও দিতে শুরু করেন তিনি। সেইসঙ্গে চলতে থাকে তার ফুটবল চর্চাও। ক্লাব ফুটবলে রীতিমতো স্টার হয়ে উঠেছিলেন বাগদাদি।

মসুলের যে এলাকা থেকে ২০১৪ সালে উত্থান ঘটে বাগদাদি খিলাফতের

ইরাকে মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাগদাদির কাকা। তার হাত ধরেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময়ে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেন বাগদাদি। তবে, শুধুমাত্র সেই গণ্ডিতেই আটকে থাকেননি বাগদাদি। ২০০০ সাল নাগাদ সালাফি জিহাদিদের সঙ্গে যোগ দেন বাগদাদি। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যেই আফগানিস্তানে জিহাদি প্রশিক্ষণ নেন বাগদাদি। নব্বই-এর দশকে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ছাত্র ছিলেন বাগদাদি। ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনী যখন ফের ইরাকে অভিযান শুরু করে তখন বাগদাদি অবশ্য পুরোদস্তুর জঙ্গি। ২০০৪ সালে তাকে প্রথম এবং শেষবারের জন্য গ্রেফতার করেছিল মার্কিন বাহিনী। তাকে পাঠানো হয় বুক্কা ক্যাম্পে, সেখানে প্রায় ১০ মাস কাটান বাগদাদি।

নানা সূত্র থেকে জানা যায়, খুব কম কথা বলতেন বাগদাদি। বন্দি থাকাকালীন বেশিরভাগ সময়েই ধর্মীয় চর্চাই চালিয়ে যেতেন তিনি। সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির নেতাদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ঘটে। বুক্কা ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ইরাকের আল কায়দাগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন বাগদাদি। যদিও, পরে ওই জঙ্গি সংগঠন ভেঙে দিয়ে তার নাম রাখা হয় ইসলামিক স্টেট। সেই সূত্রপাত। বিরোধী গোষ্ঠীগুলিকে এক জায়গায় আনার ক্ষমতা, ধর্মীয় পড়াশোনা এই সমস্ত কিছুই বাগদাদিকে নেতা হিসেবে উঠে আসতে দারুণ সাহায্য করেছিল। জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেয় সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্টির একাধিক সদস্য এবং ইরাকি সরকারের সেনাকর্তাদের অনেকেই।...

* এককভাবে আইএসের বিস্তার ও বাগদাদির ভূমিকা
২০১০ সালের এপ্রিল মাসে বাগদাদিকে নতুন আমির ঘোষণা করা হয়। তখনও অবশ্য আল কায়দার সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের সম্পর্ক টিকে ছিল। কিন্তু, ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন নেভি সিলের অপারেশন নেপচুন স্পিয়ারে নিহত হন আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেন। তার পর আল কায়দার দায়িত্ব নেন আয়মান আল জাওয়াহিরি। কিন্তু, ততদিনে ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে পিছু হঠতে শুরু করেছে আল কায়দা। বদলে, সেই জায়গা দখল করে নিতে থাকে ইসলামিক স্টেট। কিন্তু, তখনও আল কায়দা ছেড়ে বেরিয়ে আসেনি তারা। ভাঙনটা শুরু হয় আল নুসরা নামে আরেকটি জঙ্গি সংগঠনকে ঘিরে। নুসরার নেতারা সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিল। কিন্তু, তার বদলে নিজের ‘সাম্রাজ্য’ গড়ে তোলাই প্রথম পছন্দ ছিল বাগদাদির। সেই সঙ্গে দখল করা এলাকায় কঠোর ধর্মীয় আইন চালু করাও ছিল তার লক্ষ্য। এ নিয়েই আল কায়দায় সঙ্গে তার সংঘাত শুরু হয়। আইএস-কে জঙ্গি সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে আল কায়দা। তাতে কার্যত শাপে বর হয় বাগদাদির।

আল কায়দার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরপরই, ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা দুর্বার গতিতে দখল করে নেয় আইএস জঙ্গিরা। ২০১৪ সালের জুন মাসে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল দখল করে নেয় আইএস। এই সময়েই নিজেকে ‘খলিফা’ হিসেবে ঘোষণা করেন বাগদাদি।

মার্কিন নিরাপত্তা বিভাগের স্যাটেলাইট ভার্সনে বাগদাদির অবস্থান শনাক্তকৃত ম্যাপ- ম্যাক্সার ইউএস

|| বাগদাদি ‘নিউট্রালাইজেশন’
সর্বশেষ সিরিয়ায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে আগ্রাসন শুরু করে আইএস। তবে এই সময় মার্কিন সেনাবাহিনী ও সিরিয়ান কুর্দি সেনাদের সমন্বিত যৌথ বাহিনীর শক্তির সামনে দুর্বল হয়ে পড়ে আইএস। শুরুতে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলসহ বেশ কয়েকটি এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নিলেও শেষ অবদি নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করে বাগিদাদির অনুসারিরা।
মার্কিন ডিফেন্স সিস্টেমের এক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, লাদেনের মৃত্যুর পর বাগদাদি যেভাবে জঙ্গিদের সমন্বিত করে তোলার কাজ শুরু করেন তা বেশ বিস্ময়কর ছিল। তারা বুঝতে পারে যে, বাগদাদি ক্রমেই লাদেনের চেয়েও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে। আর তাই সিরিয়ার আইএস বিরোধী অভিযানে বিধ্বংসী ভূমিকা নেয় মার্কিন স্পেশাল টাস্কফোর্স। বাগদাদির খোঁজে সারা সিরিয়াজুড়ে চলে লাগাতার অভিযান, আইএস ঘাঁটিগুলোতে আকাশপথে চালানো হয় 'থান্ডার স্ট্রাইক'-এর মতো বিমান হামলা। এক পর্যায়ে সিরিয়ার সকল আইএস অধিকৃত অঞ্চল মার্কিন-কুর্দিশ যৌথ বাহিনীর পুনর্দখলে এলেও নাগালের বাইরে থেকে যান বাগদাদি।

অবশেষে গত শুক্রবার রাতে আল বাগদাদির ‘হাইড আউট’ শনাক্ত করার পর নীরবে তার অবস্থান ঘিরে অভেদ্য বলয় গড়ে তোলে মার্কিন মেরিন সেনাদের একটি বিশেষ টাস্কফোর্স। ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়া হয় বাগদাদির রসদ পৌঁছানোর সকল পথ। শনিবার অবরুদ্ধ ও কোণঠাসা অবস্থায় বাগদাদিকে আটকের জন্য নির্দিষ্ট অবস্থানে হানা দেয় মার্কিন সেনারা। এ সময় একটি পরিত্যক্ত টানেলের ভেতরে অবরুদ্ধ বাগদাদি নিজের সঙ্গে থাকা সুইসাইডাল ভেস্টের আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটান। 

ঘিরে রাখা টানেল সংলগ্ন এলাকা পর্যবেক্ষণ শেষে তার ভেতরে প্রবেশ করে টাস্কফোর্সের সেনারা। পরবর্তীতে সেখান থেকে উদ্ধারকৃত একটি বিচ্ছিন্ন মরদেহের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে সেটি বাগদাদির বলে শনাক্তকরণের নিশ্চিত তথ্য প্রকাশ করে দেশটির প্রশাসন। এর কিছু সময় পর, এক অডিও বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে বাগদাদির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন আইএসের এক মুখপাত্র।

তথ্যসূত্র সহায়ক : দ্য রয়টার্স, ইউএস ডিফেন্স জার্নাল, দৈনিক আনন্দবাজার, উইকিপিডিয়া

এসকে/ এফসি

আরও পড়ুন