• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০১৯, ১০:০৩ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৮, ২০১৯, ১০:০৪ এএম

বাঁশ বেতের কাজ করে ৪ হাজার পরিবার স্বাবলম্বী 

বাঁশ বেতের কাজ করে ৪ হাজার পরিবার স্বাবলম্বী 

গল্পটা শুরু আজ থেকে বছর দশেক আগের। তিন সন্তান নিয়ে বাবলু মিয়াকে (৫২) তখন সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো। এক দিকে সন্তানদের লেখাপড়া, অন্য দিকে ঘরে অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা-মার চিকিৎসা খরচ যোগান দিতে হতো। সারা দিন মানুষের বাড়িতে কাজ করে যা রোজগার করতেন তাই দিয়েই চলতে হতো তাকে। সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। এখন তিনি বাঁশ বেতের কাজ করে স্বাবলম্বী।

বাবলু মিয়ার বাড়ি নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার ভেটুয়াকান্দা গ্রামে। ১০ বছর আগে বাবলু মিয়া টাংগাইলের নাগরপুর থেকে প্রথমে তিনি মাছ ধরার ফাঁদ (বাইর) বানানো শিখেন। এরপর বাবলু মিয়া ২০০৯ সালের আষাঢ় মাসে শ্রম বিক্রির ৩শ টাকা দিয়ে বাউসি বাজার থেকে কিনে আনেন এক হালি মড়াল বাঁশ। পরীক্ষামূলকভাবে চারটি টাংগাইললিয়া ও একটি কইধর বাইর বানান। বারহাট্টা গোপালপুর বাজারে নিলে এই প্রথম নেত্রকোণায় টাংগাইললিয়া বাইড় দেখে ক্রেতাদের নজর কাড়ে সহজেই। অল্পক্ষণের মধ্যে ভিড় জমে ক্রেতাদের। এ সময়  রাশিদ নামের এক সৌখিন মাছ শিকারীর কাছে প্রতিটি ৩শ টাকা করে চারটি বাইড় বারশ’ টাকায় বিক্রি করেন। 

বাবলু মিয়া জানান, প্রথম বর্ষায় মাছ ধরার মৌসুমে নিজের পরিবারের খাইয়ে-পড়িয়ে ৩০ হাজার টাকা আয় থাকে তার। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি তাকে। গত ১০ বছরে মাছ ধরার ফাঁদ (বাইর) বানানো ও বিক্রির ব্যবসা করে বাড়িতে টিনের একটি চৌচালা ঘর নির্মাণ এবং বড়ইতলা বাজারে বাইড় বিক্রির আড়ৎ প্রতিষ্ঠা করেছেন। স্কুলে যাচ্ছে তার ছেলে মেয়েরা। বাবলুর দেখাদেখি তার নিজ গ্রাম ভেটুয়াকান্দা ছাড়াও আশপাশের শেখেরপাড়া, বড়ইতলা, ময়মনসিংহ ধুবাহালাসহ অন্তত ১০-১২টি গ্রামের ৪ হাজার পরিবারের মানুষ মাছ ধরার ফাঁদ (বাইর) বানানো ও বিক্রির ব্যবসা করে এখন স্বাবলম্বী। 

বড়ইতলা ও ভেটুয়াকান্দা গ্রামের কাসেম এবং আমীন জানান, টাংগাইললিয়া বাইর বানানোর কারিগর ও ব্যবসায়ী জনৈক ছন্দু মিয়া বিক্রির জন্য বাইর নিয়ে আসেন বারহাট্টা গোপারপুর বাজারে। তার কাছে প্রথমে বাবলু ও সাবেক মেম্বার রব, বাইর কিননিয়া বাইর বানাইয়া শিহে এবং মাছ মারে (মাছ ধরা), নিজেরা খায় এবং বাইর বিক্রির ব্যবসা করে তাদের মইধ্যে বাবলু অহন পুলাপান লইয়া খাইয়া-পইরিয়া বছর বছর কমবেশী জমি কিনে। আগে খুবু গরিব আছিন, খাইত পাইতো না। বাবলু অহন ভালা ধনী। তারার দেহাদেহি আমিসহ আশপাশের শেখেরপাড়া, বড়ইতলা, ময়মনসিংহ ধুবাহালা সহ অন্তত ১০-১২টি গ্রামের প্রায় প্রতিটি গরিব পরিবারের আন্ডা-বাচ্ছা (ছোট-বড়) ধইররিয়া ছোটটু-ছোটটু করে (ছোট আকারে) কম-বেশী পুঞ্জি (পুঁজি) নিইয়া বাইর বানাইয়া মাছ ধইররেয়া ও বাড়ই বেইচ্যা ব্যবসা করে আমরা আয়-উন্নতি করতাছি। অহন আর আমরার মানুষের বাড়িত কামলা দেওনের লাইগা কাম খুজতে (খুজ) হয় না। অহন ১০-১২ গ্রামের মাইধ্যে কামলা নাইগগিয়া। কামলার (শ্রমিক) অভাব। আমরা ছুডু চাচা কাইল্লা চাচারে পুর্বধলার চোচাউড়াততে বহুত খুইজজিইয়া- খুইজজিইয়া কামলা-ছেরা (ছেলে) মিলাইছে।

ভেটুয়াকান্দা গ্রামের মরহুম এলাহি নেওয়াজ’র ছেলে হুমায়ুন বলেন, আমাদের এলাকাটি একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল। এখানে বেশির ভাগ মানুষ ছিল, হতদরিদ্র-কেটে খাওয়া মানুষ। বাবলু ও রব মিয়ার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেরা নিজেদের উদ্যোগে বাঁশ-বেতের মাছ ধরার ফাঁদ (বাইর) তৈরি ও বিক্রয় করে আয়-রোজগার করায় এলাকার ১০-১২টি গ্রামের লোকজনের জীবন-জীবিকার জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। অর্থাৎ তারা এখন স্বাবলম্বী। আমি বলব দ্রব্য মূল্য ঊর্ধ্বগতির দিনে এই কর্মজীবী মানুষের বাঁশ-বেত হস্তশিল্প উন্নয়নের স্বার্থে হস্তশিল্পের সাথে জড়িত কারিগরদের আর্থিক প্রণোদনাসহ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। 

নেত্রকোণার বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক আকরাম হোসেন বলেন, এক সময় কুঠির শিল্পের দেশ-বিদেশ কদর ছিল। গ্রাম-বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে স্বল্প পুঁজিতে ছোট ছোট আকারে শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। বাঁশ-বেতের বাইর নির্মাণ এই কুঠির শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। নেত্রকোণা সদর ও  বারহাট্টা উপজেলার ২০-২৫টি গ্রামের হাজার হাজার পরিবারের সদস্যরা এই শিল্পের সাথে জড়িত। আগে তাদের দু’বেলা আহার জোটত না। এখন তাদের খাবারের সমস্যা নেই। ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে যায়। এই শিল্পের সাথে জড়িতদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তার ব্যবস্থা করা গেলে তারা অধিক উপকৃত হবে এবং অন্যেরা এই কাজে উৎসাহীত হয়ে নিজেদের ভাগ্য পাল্টানোর সুযোগ পাবে। 

কেএসটি

আরও পড়ুন