• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০১৯, ১০:৩৩ এএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১৪, ২০১৯, ১০:৩৭ এএম

পঙ্গু হাসপাতাল

জেল-জরিমানাতেও থামানো যাচ্ছে না দালালচক্রের উৎপাত

জেল-জরিমানাতেও থামানো যাচ্ছে না দালালচক্রের উৎপাত
ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত পঙ্গু হাসপাতাল- ছবি: জাগরণ

ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, তাদের দেয়া জেল-জরিমানা কোনো কিছুতেই থামছে না দালালের উৎপাত। এমনটাই দেখা গেছে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত পঙ্গু হাসপাতালে। আইনের ফাঁকফোঁকর গলিয়ে জামিনে মুক্তি লাভের পর নতুন কৌশলে দালালি চলছে। হাসপাতালের কিছু চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর যোগসাজশে বিশাল সংখ্যক বহিরাগত লোকজন বেশ কয়েক বছর ধরে দালালির জালে আটকাচ্ছে ঢাকার বাইরে থেকে আসা সহজ-সরলমনা রোগীদের। তাদের খপ্পরে পড়ে অযথা মোটা অংকের টাকা-পয়সা খোয়ানোর সঙ্গে জীবন চলে যাবার ঘটনাও আছে।

গত কয়েকদিনের সরেজমিন অবস্থানে এমন চিত্র এসেছে দৈনিক জাগরণের কাছে।

গত ৫ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে এম্বুলেন্সে করে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে পঙ্গু হাসপাতালে আনা হয় আকলিমা খাতুনকে (৪২)। বাড়ির উঠান ঝাড়ু দেয়ার সময় পড়ে কোমরে চোট পান তিনি। পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগ আঙিনায় এম্বুলেন্সের গেট খুলে আকলিমাকে নামানো মাত্রই একটি ট্রলিসহ ৪/৫ জনকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়। এসময় ট্রলির সঙ্গে আসা একজন যুবক আকলিমার স্বামী মোজাম্মেলকে বলতে থাকেন, এইখানে যে আনছেন, চিকিৎসা তো ভাল পাইবেন না। সামান্য কয়টা টাকার জন্য রোগীটারে এইখানে রাইখা কষ্ট দেয়ার কোনো মানে নাই। আরেকটু খরচ করলে পাশে কত ভাল ভাল প্রাইভেট হাসপাতাল আছে, সেইখানেও তো নিতে পারেন।

এসব কথা মনে ধরে যায় মোজাম্মেলের। আকলিমাকে জরুরি বিভাগে প্রবেশ না করিয়েই সলাপরামর্শ করতে থাকেন রতন নামের ওই যুবকের সঙ্গে। কিন্তু এসময় আকলিমার ছোট ভাই জুলহাস এসে সব শোনার পর মোজাম্মেলের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, দালালের কথায় আমার বোনের চিকিৎসা হবে না। বলেই বোনকে ট্রলি দিয়ে জরুরি বিভাগের দিকে নিয়ে যান জুলহাস। এসময় রতনসহ আরও ৪/৫জন যুবক গায়েব হয়ে যান। তাদের দেখা আর পাওয়া যায়নি।

পরে কথা হয় মোজাম্মেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, হাসপাতালের নাম কইসে না, খালি কইছে এই পাশেই (শ্যামলী এলাকা) বলে ভালা-বড় হাসপাতাল আছে, সেইটাত নিবো।

এ ঘটনার পর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও সেই ৪-৫ যুবকের চেহারা দেখা গেল না। ৫ নভেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালক ফয়সালের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন, এখন অনেক কমছে, আগে তো রোগী গাড়ি থেইকা নামানির আগেই ভাইল (গলিয়ে) দিয়া লাইতো। হাসপাতালের বাইরের লোকজনের সঙ্গে মিল্লা ভিতরের লোকজনই এসব দালালি করে। বহুত দেখছি-হুনছি এইসব কাহিনী।

পুলিশ ও হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, পঙ্গু হাসপাতাল ঘিরে অন্তত দুই-আড়াইশ দালাল বেশ কয়েকভাগ হয়ে দালালি করে যাচ্ছে। তারা জানেন, কখন হাসপাতালে এমন রোগী আসেন, যাদের সমস্যা গুরুতর। হাসপাতালের ভেতর থেকেই কোনো না কোনো কর্মচারী তাদেরকে মোবাইল ফোন করে খবর দেয়। বিনিময়ে পায় কমপক্ষে এক হাজার টাকা কমিশন। তাছাড়া দেখতে ভবঘুরের মতন যুবক বয়সী কিছু লোকজন সবসময় দেখা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেট ও এর আশপাশে। এদের অনেকেই দালাল বা দালালের সোর্স। দালাল চক্রের সঙ্গে হাসপাতালের কতিপয় কর্মচারী ও নার্সের যোগসাজশ থাকায় আইনশৃংখলা বাহিনী অভিযান চালিয়েও দমাতে পারে না দালাল চক্র। আবার অনেক সময় গ্রাম থেকে আসা সরলমনা রোগীরা বুঝে উঠতে পারেন না, কে দালাল, কে হাসপাতালের কর্মচারী। এতে করেও অনেকে পড়েন দালালচক্রের খপ্পরে।

জানা যায়, পঙ্গু হাসপাতাল এলাকার আশপাশে অন্তত অর্ধশতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক আছে। এসবের মালিকরাই পুষে থাকেন ওইসব দালালদের। একই দালাল কয়েক হাসপাতালের হয়েও কাজ করেন। একসময় পঙ্গু হাসপাতালের দালাল ছিলেন আনোয়ার। বর্তমানে মুদি দোকানদারী করেন আগারগাঁও বিএনপি বাজার এলাকায়।

তিনি দৈনিক জাগরণকে বলেন, বহুত জেল খাটছি, মানিজ্জত গেছে, এলাকায় মুখ দেখাইতে পারতাম না। কিন্তু টেকার লোভ সামলাইতে পারতাম না। বহুত কষ্টে ছাড়ছি। আসলে এই যে লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুর, সেইখানে ২০-৩০টা হাসপাতাল আছে। একটারও কইলাম নিজের ডাক্তার, নার্স নাই, সব টাউটারি করে, হেরাই এইসব দালাল পালে। হেগোরে থামাইলেই দালালি ছুইট্টা যাইব গা (থেমে যাবে)।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়- বর্তমানে পঙ্গু শওকত, জাহিদ, সাদেক, বাশার, নুরু, রিফাত, নাহিদ, মজনু, হাজেরা, নাজিম, রেজাউল, শাহানা, সুমন, সিদ্দিক, মোকাররম, আলী, রুবেল , রানা, শহিদুল্লাহ, জহিরুল, মামুন নেতৃত্বাধীন দালাল গ্রুপগুলো সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। একেকটি গ্রুপে বিভিন্ন বয়সী ১০ থেকে ২০ জন দালাল আছে। তাদের কেউ হাসপাতালের কোনো কর্মচারীর নিকটাত্মীয়, কেউ স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার কর্মী, কারও আছে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক পরিচয়। ফলে হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা এদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস পান না। এ সুবাদে রোগী ভাগিয়েই যাচ্ছে দালাল চক্র।

২০১৭ সালের শেষ দিকে ২৪ দালালকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারা হলেন- পঙ্গু হাসপাতালের কর্মচারী হুমায়ুন ও মাহফুজা, দালাল গোলাম মোস্তফা, আলম, আহসান হাবীব, আমির হোসেন, দুলাল, জহির, মমিন মিয়া, রবিউল ইসলাম, রিনা বেগম, মঞ্জু মাহমুদ, জসিম, সজীব সরকার, আবুল কালাম আজাদ, মালেকা বেগম, আলাউদ্দিন, রাশেদ, সুমন, ফিরোজ আহমেদ, গোলাপী বেগম, সাহিদা বেগম ও পারভীন।

২০১৮ সালের প্রথমভাগে দালালদের গডফাদার খ্যাত নুরুন্নবী পরিচালিত ক্রিসেন্ট হাসপাতালের দুই ভুয়া চিকিৎসকসহ ৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। চিকিৎসক না হয়েও অস্ত্রোপচার করার দায়ে হাসপাতালটির মালিক নুরুন্নবীকে ৬ বছর আগে এক বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল। তখন তার মালিকানায় পরিচালিত মক্কা-মদিনা হাসপাতালটি বন্ধ করা হয়। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি আবার ক্রিসেন্ট হাসপাতালটি চালু করেন। মেয়াদোত্তীর্ণ রক্ত ব্যবহার করার দায়ে ওই হাসপাতাল আবার বন্ধ করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- কলেজগেট, বাবর রোড, শ্যামলী আগারগাঁও এলাকায় অন্তত ৮টি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক নুরুন্নবী। আইন অমান্য করায় বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত তার তিনটি হাসপাতাল বন্ধ করে। কিন্তু থেমে থাকে না নুরুন্নবী। নতুন নামে হাসপাতাল খুলে বসে। ২০১৫ সালে ভুয়া চিকিৎসক দিয়ে অস্ত্রোপচার করার দায়ে আগারগাঁওয়ে নুরুন্নবীর মালিকানায় পরিচালিত মরিয়ম হাসপাতালটি বন্ধ করা হয়। এই নুরুন্নবী ও তার দলবল এখনও ওই এলাকায় খুব সক্রিয় বলে জানা যায়।

পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল গণি মোল্লা দৈনিক জাগরণকে বলেন, মানুষকে সচেতন হওয়া দরকার। একজন বলবে বাইরে ভাল চিকিৎসা হয় আর সেটা বিশ্বাস করে তার সঙ্গে চলে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে আমাদের হাসপাতাল অনেক উন্নত হয়েছে। শয্যা সংখ্যা বেড়েছে।

একটি প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালের কেউ দালালির সঙ্গে জড়িত কি-না, সেটা আমরা সবসময়ই খেয়াল রাখি। প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পূর্বের চেয়ে পঙ্গু হাসপাতালে দালালদের উৎপাত অনেক হ্রাস পেয়েছে বলে দাবি করেন পরিচালক।

আরএম/টিএফ

আরও পড়ুন