দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী'
আজ ২৯ জুন, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৪৬তম প্রয়াণ দিবস। ১৮৭৩ সালের এই দিনে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতার এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যের এ উজ্জল জ্যোতিষ্ক।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্ম নিয়েছিলেন যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি, শনিবার। পিতা রাজ নারায়ণ দত্ত ছিলেন তৎকালীন সময়ে কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের একজন বিখ্যাত উকিল। তার মাতা জাহ্নবী দেবী ছিলেন তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত কাঠিপাড়ার বিখ্যাত জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা।
শিশুকালে মধুসূদনের হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁদের বাড়ির চন্ডী মন্ডপে। এরপর তিনি তাঁর গ্রামের নিকটবর্তী শেখপুরা গ্রামের এক মৌলভী শিক্ষকের নিকট ফারসী শিখতেন। এই চন্ডী মন্ডপের শিক্ষা ও মৌলভী শিক্ষকের শিক্ষায় তার প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি রচিত হয়েছিল।
মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আইন ব্যবসায়ে তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। তাছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন(অর্থাভাবে) অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডের যে খৃস্টান কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছিল সেখানে তার চারদিন আগে কবির জীবন সঙ্গী ও প্রিয়তমা স্ত্রী হেনরিয়েটাকে সমাহিত করা হয়েছিল। কবির স্ত্রীর পাশেই শোয়ানো হয় কবিকে।
মাইকেল মধুসূদনের কর্মজীবন কুসুমশোভিত ছিল না। উপার্জনের তুলনায় ব্যয়ের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি হওয়ার কারণে তার সংসার জীবনে আর্থিক দৈন্য কোনোদিনই কাটেনি।
তার জীবনের ইতিহাসে আমরা দেখি যে, তিনি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, শিক্ষকতা করেছেন, পুলিশ কোর্টের কেরানি ছিলেন সাংবাদিকতা করেছেন, আইন ব্যবসা করেছেন, অনুবাদকের কাজও করেছেন কিন্তু কোনোভাবেই কবির সংসার জীবনে আর্থিক অসচ্ছলতা কাটেনি। কপর্দক শূন্য অবস্থায় তিনি পরলোক গমন করেন।
যে কবি জন্মে ছিলেন সোনার চামচ মুখে দিয়ে, কিন্তু জীবন কাটে কবির দীনতার চরম কষ্টে।
‘দাঁড়াও পথিকবর জন্ম যদিতব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল... সাগরদাঁড়ি গ্রামে কবির জন্ম ভিটায় শ্বেত পাথরে তার এই কবিতার পঙক্তি নজরে পড়লেই কবিভক্ত ও পর্যটকদের ক্ষণকাল দাঁড়াতেই হয়।
কবির জন্ম ভিটায় সাগরদাঁড়ি, যার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কপোতাক্ষ নদ। যে নদ দেখলেই মনে পড়বে সেই ‘কপোতাক্ষ নদ' কবিতার লাইন দু'টি।
‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম ভিটা বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগ অধিগ্রহণ করেছে। এখানে তৈরি করা হয়েছে মধুপল্লী। মাইকেল মধুসূদন ইনস্টিটিউশন।
কবির জন্ম ভিটায় প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে কবির আবক্ষ মূর্তি। বাড়ির উঠানে জমিদার বাড়ির ঠাকুরঘর। তারপর প্রতিটি ঘরে কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাব রয়েছে। বাড়ির চারপাশ ফুলের বাগানে ঘেরা। কবির জন্ম ভিটার পূর্ব ও পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদী কপোতাক্ষ।
জেলা পরিষদ ডাক বাংলোর সামনেই রয়েছে কবির স্মৃতিময় ঐতিহাসিক বাদাম গাছ। এরপর পিছনে রয়েছে বিদায় ঘাট। যেখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলকাতা থেকে স্ত্রী হেনরিয়েটা, সন্তান মেঘনাদ মিল্টন ও শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। কিন্তু জমিদার বাবা তাকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেননি।
জনশ্রুতি রয়েছে, বাব-মা মারা যাওয়ার পর ১৮৬২ সালে কবি শেষবারের মতো সপরিবারে বজরায় চেপে সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে বাড়িতে ওঠার অনুমতি মেলেনি। শেষে এই কাঠবাদাম গাছতলায় তাঁবু খাটিয়ে ১৪ দিন থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। যে ঘাটে বজরা ভিড়িয়ে ছিলেন বর্তমানে তার নাম বিদায় ঘাট। এই বিদায় ঘাটের এখানে একটি ফলকে খুদিত রয়েছে মহাকবির রচিত ‘কপোতাক্ষ নদ' কবিতাটি।
আরআই