• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২০, ০৬:৩৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৫, ২০২০, ০৬:৪৬ পিএম

বিজয়ের এক নীরব সাক্ষী

বিজয়ের এক নীরব সাক্ষী

তখনো দিনের আলো ঠিকমতো ফোটেনি। তার ওপর শীতের ভোর। চারদিকে ঘন কুয়াশা। এলাকাটা গাছপালায় ঢাকা। সারাটা রাত ঠান্ডার মধ্যেই খোলা আকাশের নিচে ছিলাম আমি। সারা রাত ধরে কুয়াশা জমেছে আমার গায়ে। জমতে জমতে এখন সেই কুয়াশা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে আমার পা বেয়ে। হঠাৎ টের পেলাম আমি নড়তে শুরু করেছি। 
কোথায় যাচ্ছি, জানি না। আমার দুপাশ থেকে দুজন তাগড়া জওয়ান আমাকে ধরে রেখেছে। আর আলতো করে তুলে ছুটে চলেছে। কোথায় যাচ্ছে ওরা? আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে নিয়ে যাচ্ছে?
গতকাল দুপুরেও আমি ছিলাম ঢাকা ক্লাবে। দুপুরের পরে হঠাৎ তিন-চারজন এসে আমাকে নিয়ে এল রাস্তার ওপারে। ছুটতে ছুটতে। মনে হলো ওদের ভীষণ তাড়া। কিসের এত তাড়া ছিল ওদের, তখনো জানতাম না। 
ওপারেই বিশাল এক ময়দান। রেসকোর্স ময়দান। ঘোড়ার দৌড়ের প্রতিযোগিতা হয় ওখানে। ঢাকা ক্লাবের ভেতর থেকেও হ্রেষাধ্বনি শোনা যেত। মানুষের চিৎকার তো ছিলই। অনেক দিন ধরে খুব ইচ্ছে ছিল ঘোড়ার দৌড় দেখার। কিন্তু কে আমাকে দেখাতে নিয়ে যাবে?
ওপারে যেতে যেতে ভাবছিলাম, আজ কি আমি সেটাই দেখতে যাচ্ছি? জানি না। তবে অনেক মানুষের হইচই শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। কিন্তু কোনো ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি শুনতে পাইনি। বরং কিছু স্লোগান শুনতে পাচ্ছিলাম, জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু! আমার নেতা তোমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব।
ভীষণ অবাক হলাম। ব্যাপারটা কী! এত বড় বুকের পাটা কাদের, জয় বাংলা স্লোগান দেয়? বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান দেয়!
মাত্র ৯ মাস আগেই তো সেই স্লোগান শুনেছিলাম এই রেসকোর্স ময়দানে। সেদিন ছিল ৭ মার্চ। বিশাল জনসভা ছিল সেদিন। লাখ লাখ মানুষ সেদিন হাজির হয়েছিল ওই ময়দানে। মাঝখানে অনেক দিন স্লোগান শুনিনি। শুনেছি কেবল গোলাগুলির শব্দ। মানুষের আর্তনাদের শব্দ। হায়েনাদের অট্টহাসির শব্দ। আকাশে জঙ্গিবিমানের বিদঘুটে আর ভয়ংকর ছুটে চলার শব্দ। আজ যদিও গোলাগুলির শব্দ খুব একটা নেই। মাঝে মাঝে একটা-দুটো। এবং আজ হায়েনাদের অট্টহাসির শব্দও নেই। তাহলে আবার সেই আগের মতো দিন চলে এল! সেই ৯ মাস আগে যে রকম দিন ছিল! 
আমাকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে ময়দানে ঢুকে পড়ল লোকগুলো। ময়দানে ঢুকে তো আমি অবাক! এত মানুষ! হাজার হাজার মানুষ! লাখ লাখ মানুষ! আমি অবাক হলাম। এত মানুষ কেন? আর এত মানুষের মধ্যে আমাকে কেন নিয়ে এল? আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
লাখ লাখ মানুষের ঠিক মাঝখানে আমাকে রাখল লোকগুলো। এবং সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘটনা কী? তখনো আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
কিছুক্ষণ পর আমার একপাশে দুটো চেয়ার ও আরেক পাশে আরেকটা চেয়ার রাখা হলো। তারপর হঠাৎ অনেক মানুষ এসে হাজির হলেন। আমার চারপাশ ঘিরে দাঁড়ালেন। একটু পর একপাশের দুটো চেয়ারে প্রায় একসঙ্গে বসলেন দুজন। একজন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। তাঁর মাথায় পাগড়ি। তিনি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কমান্ডার। অরোরার বাঁ পাশে যে বসল তার নাম লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক।
দুজনের সামনে একটা কাগজ দেওয়া হলো। ওটা আত্মসমর্পণের দলিল। 
নিয়াজীকে কলম বাড়িয়ে দিলেন অরোরা। তারপর চেয়ার টেনে বসলেন। নিয়াজী সেই কলম হাতে নিয়ে বসল। তারপর দলিলে স্বাক্ষর করল।
আর তারপরই উল্লাসে ফেটে পড়ল আশপাশের মানুষ। আগের চেয়েও জোরে জোরে স্লোগান দিতে লাগল সবাই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব।
হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল চারপাশ।
শীতের সন্ধ্যা। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ল সব। এই উদ্যান, এই আমি, তিনটে চেয়ার, গাছপালা, লাখো মানুষের পদচিহ্ন, সব।
সন্ধ্যার পরও উদ্যানের বাইরে থেকে স্লোগানের শব্দ শুনতে পেলাম। শুনতে পেলাম লাখো মানুষের উল্লাসধ্বনি। কখনো কখনো দু-চারটে গুলির শব্দ। তবে এই গুলির শব্দগুলো কদিন আগের গুলির শব্দের মতো নয়। আগের গুলির শব্দ শুনলে বুক কেঁপে উঠত অজানা আশঙ্কায়। কিন্তু এই গুলির শব্দ ছিল উল্লাসধ্বনির মতোই।
স্লোগান আর মানুষের উল্লাসধ্বনি একসময় দূর থেকে দূরে সরে যেতে লাগল। তারপর একসময় হারিয়ে গেল। তারপর আর কিছুই মনে নেই আমার। আর একটু আগে হঠাৎ দেখলাম, আমি নড়তে শুরু করেছি। কোথায় যাচ্ছি আমি?
আমার চারটি পা। কিন্তু আমি নিজে চলাফেরা করতে পারি না। কারণ, আমি টেবিল।
আমি জানি না আমি কোথায় যাচ্ছি। তবে যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকালাম। নাহ। আমার দুপাশে তিনটা চেয়ার ছিল। ওদের কোথাও দেখতে পেলাম না। চেয়ারগুলো কোথায় ভাবতেও পারছিলাম না। কারণ, আমি যে পথে এসেছিলাম, সে পথে যাচ্ছি না।
চারপাশে তাকালাম। একটা মানুষও দেখতে পেলাম না, কেবল দুজন ছাড়া। এ দুজনই আমাকে আলতো করে তুলে নিয়ে ছুটছে। কোথায় ছুটছে ওরা? গতকাল বিকেলে তো ওদের দেখিনি! ওরা কারা? জানলাম কিছুদিন পর।
উদ্যান থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরের ঘটনা। 
মধ্য দুপুরের ঠিক আগে আগে হন্তদন্ত হয়ে একজন ছুটে এলেন উদ্যানে। ঠিক আমি যেখানটায় ছিলাম, সেখানে। তারপর এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। কয়েকজন ভারতীয় সৈনিক আয়েশি ঢঙে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গতকাল বিকেলে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেছেন এ সৈনিকরা। একজন সৈন্যের কাছে জানতে চাইলেন লোকটি, ‘যে টেবিলে দলিল সই হয়েছে সেটি কোথায়, জানেন কিছু?’
‘আপনি কে?’
‘আমার নাম ফিরোজ মাহমুদ। আমি জাতীয় জাদুঘরের প্রধান নির্বাহী। টেবিলটাকে দেখেছেন? চেয়ারগুলো?’
ভারতীয় সৈন্যরা মাথা নাড়লেন। তাঁরা কিছুই জানেন না। তবে একজন জানালেন, ‘আপনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে খোঁজ নিতে পারেন।’
কথাটা মনে ধরল ফিরোজ মাহমুদের। টেবিলের পেছনে গোয়েন্দাগিরি শুরু করলেন তিনি। আমাকে উদ্ধার করার সংকল্প করেছেন তিনি। কারণ, আমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি দেশের স্বাধীনতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। বিজয়ের ইতিহাস। তিরিশ লাখ মানুষের রক্তের ইতিহাস।
ফিরোজ মাহমুদ যখন আমার খোঁজ করছিলেন, আমি কিন্তু তখন সামান্য দূরে ছিলাম। হাঁটাপথ। কিন্তু ফিরোজ মাহমুদ তো আর সেটা জানতেন না। কাজেই পরদিন তিনি এক বন্ধুসহ গিয়ে হাজির হলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।
নিজের পরিচয় দিলেন। বললেন, ‘আমি টেবিলসহ কিছু নিদর্শন জোগাড় করছি।’
‘আপনার পরিচয়পত্র?’
এবার আটকে গেলেন ফিরোজ। তাঁর তো পরিচয়পত্র নেই। দুদিন হলো দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন তিনি পরিচয়পত্র কোথায় পাবেন? আগের পরিচয়পত্রটা কোথায় আছে কে জানে।
পরিচয়পত্র না থাকার অজুহাত কাজে লাগাল ক্যান্টনমেন্ট। তাঁকে কোনো সহায়তা করতে রাজি হলো না কেউ।
ক্যান্টনমেন্টের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন ফিরোজ। যদি কোনো সুযোগ পাওয়া যায়! তাঁকে ও রকম ঘোরাঘুরি করতে দেখে এগিয়ে এলেন এক বাঙালি অফিসার। কিছুটা কড়া কণ্ঠে বললেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট জায়গাটা এখন মোটেও নিরাপদ নয়। যেকোনো সময় অপ্রীতিকর কিছু ঘটে যেতে পারে। আপনি চলে যান।’
চলে এলেন ফিরোজ। আমার খোঁজ না পেয়ে তাঁর মন খারাপ হয়েছিল। তাহলে কি আমার খোঁজ মিলবে না? আমি কি এভাবেই আড়ালে রয়ে যাব? অন্ধকার ঘরে?
ফিরোজ মাহমুদের শুধু মনটাই খারাপ হয়েছিল। তবে হতাশ হননি। আবার নতুন উদ্যমে আমার খোঁজ শুরু করলেন তিনি। এবার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনের বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন সংগ্রহ। সাধারণ মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের যা যা নিদর্শন আছে, তা জাদুঘরে দেওয়ার আহ্বান জানান। মনে তাঁর তুমুল আকাঙ্ক্ষা, যদি আমার হদিস পান!
বেশ কিছুদিন ধরে বিজ্ঞাপন দেন ফিরোজ মাহমুদ। তখন জাদুঘরের কর্মীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। তাঁদের নিয়েই সংগ্রহ করতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের নানান নিদর্শন। গুলির খোসা, কামানের গোলা। কিন্তু আমার কোনো খবর তখন অব্দি পাননি।
একদিন এই সংগ্রহের কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন ফিরোজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাবে কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। হঠাৎ জাদুঘরের এক কর্মী হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলেন। ফিরোজকে বললেন, ‘স্যার, ভালো খবর আছে। নিয়াজীর আত্মসমর্পণের টেবিলের খোঁজ পাওয়া গেছে!’
কথাটা শুনেই ফিরোজ মাহমুদ চঞ্চল হয়ে উঠলেন। জলজল করে ওঠল চোখ দুটো। জানতে চাইলেন, ‘কোথায়?’
‘এই তো পাশেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কো-অপারেটিভ স্টোরে।’
এক সেকেন্ডও দেরি করলেন না ফিরোজ মাহমুদ। ছুটে গেলেন স্টোরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কো-অপারেটিভ স্টোরের পাশে ছোট্ট একটি থাকার মতো ঘর। ওই ঘরে ঢুকেই বিস্মিত হলেন ফিরোজ। তাঁর চোখের সামনে আমি। আত্মসমর্পণের ছবিতে দেখা আমাকে তিনি মগজে গেঁথে নিয়েছিলেন। সেই ছবির সঙ্গে মেলাতে থাকলেন আমাকে।
আমাকে বানানো হয়েছে সেগুন কাঠ দিয়ে। লম্বায় ৫ ফুট। পাশে ২ ফুট। আর উচ্চতা ৩ ফুট। সরু সরু পা। আমার গায়ে বিশেষ কোনো কারুকাজ নেই। চার কোনায় কেবল ঢেউয়ের মতো ডিজাইন করা। আর গায়ে হালকা হলুদ রঙের বার্নিশ।
খুশি হলেন ফিরোজ মাহমুদ। তাঁর গলায় উচ্ছ্বাস, ‘মিলে গেছে। হুবহু মিলে গেছে! এটাই সেই টেবিল।’
সত্যি এটাই সে-ই আমি, যা তিনি খুঁজছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু আমি এখানে কী করে এলাম, সেটা তিনি জানেন না। আমি তো কথা বলতে পারি না। তাই তাঁকে বলতে পারলাম না। কাজেই তিনি এবার খোঁজ নিতে লাগলেন, আমি কী করে এই স্টোরের পাশের ঘরে এলাম।
ফিরোজ মাহমুদ জানতে চাইলেন, ‘এ ঘরে কে থাকে?’
ততক্ষণে দু-চারজন উঁকিঝুঁকি মারছিল ঘরটায়। কেউ একজন জবাব দিল, ‘এটা স্টোরের অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. ইসমতের ঘর।’
খবর পেয়ে ছুটে এলেন ইসমত। বিশ-একুশ বছরের তরুণ। লেখাপড়া করছে। পাশাপাশি চাকরিও করছে। আমার ওপর তাই স্তূপ করে বই রেখেছে।
ফিরোজ মাহমুদ জানতে চাইলেন, ‘টেবিলটা কোথায় পেয়েছ?’
এবার বলতে শুরু করলেন ইসমত।
‘১৬ ডিসেম্বর আমি আর আমার বন্ধু আবদুল বারেক গিয়েছিলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বারেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বেয়ারা। নিয়াজী আত্মসমর্পণ করবে, এই আনন্দের দৃশ্যটা দেখতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু দেখতে পারিনি। লাখ লাখ মানুষ। মানুষের ভিড় ঠেলে সামনে যেতে পারেনি। তার ওপর ছিল নিরাপত্তা বেষ্টনী। মূল অনুষ্ঠানের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারিনি আমরা। নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করাও দেখতে পারিনি। তাই বলে হতাশ হইনি। ঠিক যে জায়গাটাতে অনুষ্ঠান হয়, পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে সেখানে চলে যাই আমরা। আশপাশে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। পুরো উদ্যান জনশূন্য। হঠাৎ একটা টেবিল চোখে পড়ল। অবজ্ঞা আর অবহেলায় পড়ে আছে মাঠে। মনে হয় টেবিলটা আর কারুরই দরকার নেই। দরকার থাকলে তো এভাবে ফেলে রেখে যেত না। এই ভেবে আমি আর বারেক টেবিলটা নিয়ে আসি। এখন এটি আমার পড়ার টেবিল।’
ইসমতের কথায় ফিরোজ মাহমুদ বুঝতে পারলেন, আমার গুরুত্বটা ইসমত বুঝতে পারেনি। ফিরোজ মাহমুদও বুঝতে দেননি। বললেন, ‘এটা জাদুঘরের টেবিল। আমি জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক। টেবিলটা আমাদের লাগবে। দিয়ে দাও।’
ইসমত বেঁকে বসলেন, ‘না। আমার টেবিল আমি দেব না।’
‘কিন্তু এটা তো জাদুঘরের টেবিল!’
‘আমি তো জাদুঘর থেকে এটা আনিনি। উদ্যানে পড়ে ছিল। ওখান থেকে এনেছি। আমি এটা দেব না। ওটা আমার পড়ার টেবিল।’
ফিরোজ মাহমুদ বুঝতে পারলেন, বেশি চাপাচাপি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমাকে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলতে পারে ইসমত। কিংবা আমাকে এমন করে ফেলতে পারে, যাতে চেনা না যায়।
আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন ফিরোজ মাহমুদ। আমি ইসমতের পড়ার টেবিল হিসেবেই রয়ে যাই ছোট্ট ঘরটায়। সবার অগোচরে।
পরদিন দুজন এল এই ছোট্ট ঘরটায়। ইসমতকে বলল, ‘আমরা জাদুঘর থেকে এসেছি।’
ইসমত জানতে চান, ‘কী চাই?’
আমাকে দেখিয়ে লোক দুটো বলল, ‘ওটা জাদুঘরের টেবিল। দিয়ে দিতে হবে। দিয়ে দাও।’
ইসমতের সেই একই জবাব, ‘আমি দেব না।’
‘দেখো, তোমাকে অনেক রকমভাবে বোঝানো হয়েছে, তুমি বুঝতে পারছ না কেন? এটা জাদুঘরের টেবিল। জাদুঘরের সম্পত্তি। তুমি নিজের কাছে রাখতে পারো না। বুঝেছ?’
‘আমি কিছুই বুঝতে চাই না। এটা আমার টেবিল। আমি কাউকে দেব না।’
নাহ। ইসমত কিছুতেই আমাকে দিতে রাজি হলেন না। কী আর করা! লোকদুটো চলে গেল।
এবার নতুন চেষ্টা করলেন ফিরোজ মাহমুদ। কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যানের কাছে গেলেন তিনি। চেয়ারম্যান রমজান আলী সরদার। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক।
ফিরোজ মাহমুদ তাঁকে বুঝিয়ে বললেন সবকিছু। সব শুনে রমজান আলী সরদার বললেন, ‘আরে! এ তো ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা কেন ব্যক্তির কাছে থাকবে। এর জায়গা জাদুঘরে। আচ্ছা আমি দেখছি।’
ইসমতকে ডেকে পাঠালেন অধ্যাপক সাহেব। বললেন, ‘ইসমত! ওই ভদ্রলোককে চেনো?’
‘চিনি। উনি আমার কাছেও এসেছিলেন।’
নির্দেশ দিলেন, ‘একই কারণে উনি এখন আমার কাছে এসেছেন। টেবিলটা ওনাকে দিয়ে দাও!’
সবাইকে অবাক করে দিলেন ইসমত। বললেন, ‘ওটা আমার পড়ার টেবিল। ওটা দেওয়া যাবে না।’
কর্মকর্তার নির্দেশও যে ইসমত অমান্য করবে, এটা ফিরোজ মাহমুদের ধারণারও বাইরে ছিল। তবু তিনি হতাশ হননি। বরং নতুন একটা প্রস্তাব দিলেন ইসমতকে, ‘তোমাকে এর চেয়েও ভালো একটা টেবিল কিনে দেব।’
অধ্যাপক রমজান বললেন, ‘উনি তোমাকে সুন্দর প্রস্তাব দিয়েছেন। এবার টেবিলটা দিয়ে দাও।’
কিছুটা নরম হলো ইসমত। তবে পুরোপুরি রাজি হলো না। বলল, ‘আচ্ছা আমি ভেবে দেখি।’
নাহ! আচ্ছা গোঁয়ারগোবিন্দের পাল্লায় পড়া গেল দেখছি! কিন্তু হাল তো ছাড়া যাবে না। আমাকে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন ফিরোজ মাহমুদ। এবার তিনি ছুটে গেলেন স্টোর ম্যানেজার ফজলুল করিমের কাছে।
আবারও ইসমতের ডাক পড়ল। ফজলুল করিম বললেন, ‘টেবিলটা দিয়ে দাও ইসমত। এটা ওনাদের টেবিল।’
আগেরবার তো কিছুটা নমনীয় ছিলেন ইসমত, এবার তা-ও নেই। বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, ‘আমি দেব না।’
‘তোমাকে দিতেই হবে। ওনাদের জিনিস নিজের দখলে রাখা অন্যায়। দিয়ে দাও।’
‘ওটা আমার পড়ার টেবিল। ওটা দিলে আমি পড়ালেখা করব কীভাবে? আমি দেব না।’
ইসমতের কথা শুনে তখন হয়তো শঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলেন ফিরোজ মাহমুদ। যে রকম গোঁ ধরে আছে, জান গেলেও ইসমত আমাকে হাতছাড়া করবে বলে তো মনে হয় না।
ফজলুল করিম বললেন, ‘উনি তোমাকে নতুন একটা টেবিল কিনে দেওয়ার কথা বলেছেন। তোমার তো টেবিল হলেই চলে। নাকি?’
‘না। আমি ওই টেবিলেই লেখাপড়া করব। ওই টেবিল ছাড়া আমার লেখাপড়া হয় না।’
অবাক হলেন ফজলুল করিম। ‘বলো কি!’
‘জি স্যার। ওই টেবিলে পড়া শুরুর পর থেকেই আমার মনোযোগ বেড়েছে। ওই টেবিলে না পড়লে আমার পরীক্ষা ভালো হবে না।’
‘তোমার পরীক্ষা কবে?’
‘সামনেই পরীক্ষা। বেশি দিন বাকি নেই।’
‘তাহলে পরীক্ষার পর টেবিলটা দিয়ে দেবে। আর যেন কিছু বলতে না হয়।’
এবার ঘাড় কাত করে জানালেন ইসমত, ‘ঠিক আছে স্যার। পরীক্ষার শেষ হলে আমি নিজেই গিয়ে দিয়ে আসব।’
ফিরোজ মাহমুদ বললেন, ‘গিয়ে দিয়ে আসার দরকার নেই। আমাদের খবর দিলেই হবে। আমরাই এসে নিয়ে যাব।’
এক মাস দুমাস করে বছরও পেরিয়ে গেল। ইসমতের কাছ থেকে কোনো খবর পেলেন না ফিরোজ মাহমুদ। তবে আমাকে চোখে চোখে রেখেছিলেন ফিরোজ মাহমুদ। যাতে ইসমত আমাকে সরিয়ে ফেলতে না পারে।
আমি একটা জিনিস বুঝে গিয়েছি। আমার ব্যাপারে ইসমত যেমন নাছোড়বান্দা, তেমনি নাছোড়বান্দা ফিরোজ মাহমুদ। ইসমত আমাকে ছাড়তে নারাজ। ফিরোজ মাহমুদও আমাকে পেতে মরিয়া। আমাকে নিয়ে ইসমত আর ফিরোজ মাহমুদের মধ্যে লড়াই চলছিল। 
এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অনেক নিদর্শন সংগ্রহ করে ফেলেছেন ফিরোজ মাহমুদ। এবার এগুলো দেখানোর পালা। একটি প্রদর্শনীর উদ্যোগও নিয়েছেন তিনি। কিন্তু আমাকে ছাড়া ওই প্রদর্শনী কেমন করে জমবে? আমার ব্যাপারে এই এক বছর চুপচাপ ছিলেন তিনি। ইসমতকে বিরক্ত করেননি। বছরখানেক পর হঠাৎ একদিন অচেনা একজন এসে হাজির। ইসমত তখন ঘরেই ছিলেন। ইসমতের হাতে একটি লিফলেট দিলেন লোকটি। লিফলেটটা হাতে নিলেন ইসমত। 
ঢাকা জাদুঘরের (এখনকার জাতীয় জাদুঘর) উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে নিদর্শন দেখানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ওই লিফলেটে। তারিখও ঠিক হয়েছে ১৯৭৩ সালের ১২ মে। শনিবার। প্রদর্শনী উদ্বোধকের ছবিও ছাপা হয়েছে। ড. কামাল হোসেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
আর বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে আত্মসমর্পণের টেবিলটিও দেখানো হবে প্রদর্শনীতে।
লোকটি বললেন, ‘লিফলেট দেখেছ ইসমত?’
ইসমত বললেন, ‘দেখেছি।’
এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ছবি দেখিয়ে লোকটি বললেন, ‘অনেক বড় বড় মানুষজন প্রদর্শনী দেখতে আসবেন। এঁরা এসে যদি টেবিল দেখতে না পান, তবে অসুবিধা হবে তোমার।’
‘কী অসুবিধা?’
‘সোজা পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে।’
‘কেন?’
‘কারণ, তুমি জাতীয় সম্পত্তি জবর-দখল করে রেখেছ। এটা অন্যায়। অনেক দিন ধরেই তুমি অন্যায়টা করে যাচ্ছ। তোমাকে অনেক অনুরোধ করা হয়েছে, তুমি শোনোনি। এবার বাকিটা পুলিশ সামলাবে।’
এবার আর কোনো কথা বললেন না ইসমত। বোঝা গেল নরম হয়ে গেছেন। এই সুযোগে লোকটি বললেন, ‘প্রদর্শনীর দিন সকালে টেবিল নিতে আসবে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। তখন কিন্তু না বলা চলবে না।’
যেমন এসেছিলেন, তেমনি হঠাৎ করে চলে গেলেন লোকটি।
সেদিনটার কথা আমি কখনোই ভুলব না। কারণ, দিনটা আমার কাছে অন্য রকম ছিল। এ দিনটার জন্য দিনের পর দিন আমি অপেক্ষা করেছি। ছোট্ট একটা ঘরে পড়ার টেবিল হয়ে থাকতে আমার মোটেই ভালো লাগছিল না। কারণ, আমি জানি আমি কী! আমি বাংলাদেশ নামের একটি দেশের ইতিহাসের অংশ।
সেদিন সকালবেলা ফিরোজ মাহমুদ এসে হাজির। ইসমত সেদিন সকাল থেকে বাইরে বেরোননি। মনে হয় অপেক্ষায় ছিলেন। আমাকে বিদায় দেওয়ার অপেক্ষায়। কম তো নয়! অনেক দিন তাঁর সঙ্গী হয়ে ছিলাম আমি।
ফিরোজ মাহমুদ বললেন, ‘প্রদর্শনী বিকেলে। টেবিলটা এখনই...’
পুরো কথা শেষ করতে দিলেন না ইসমত। বললেন, ‘নিয়ে যান। রেডি করে রেখেছি। ওই তো...’
তারপর আমাকে দেখিয়ে দিলেন। 
আমাকে এভাবে দেখেই খুশি হলেন ফিরোজ মাহমুদ। আমার বুকের ওপর অনেকগুলো বইয়ের বোঝা ছিল। আগেই সব নামিয়ে রেখেছিলেন ইসমত। তারপর আমাকে ঝেড়ে মুছে পরিচ্ছন্ন করেছিলেন। কিন্তু এ কী! ইসমতকে এমন দেখাচ্ছে কেন? চোখে-মুখে বেদনার ছাপ। যেন কোনো প্রিয়জনকে বিদায় দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর। আমি অবাক হলাম। আমি তাঁর এতটা প্রিয় ছিলাম, জানতাম না!
ফিরোজ মাহমুদের চোখ এড়াল না সেটা। জানতে চাইলেন, ‘মন খারাপ তোমার?’
মুখে নয়, ওপর নিচে মাথা নেড়ে জবাব দিলেন ইসমত।
‘আমি তোমাকে একটা খুব সুন্দর দেখে টেবিল কিনে দিই?’
‘না। কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি টেবিলটি দেব না। এমনিই দিয়ে দিলাম।’
যাক! আমাকে নিয়ে ইসমত আর কোনো ঝামেলা করবেন না। নিশ্চিত হলেন ফিরোজ মাহমুদ। আর নিশ্চিত হয়ে বললেন, ‘দেখো ইসমত, এটা এখন আর শুধু একটি টেবিল নয়। জাতির সম্পদ। জাদুঘরে থাকলে সবাই দেখতে পাবে। ইতিহাসটি জানতে পারবে। এবং এই ইতিহাসের সঙ্গে তোমার নামটাও জুড়ে গেল। টেবিল প্রদানকারী হিসেবে তোমার নাম লেখা থাকবে সব জায়গায়।’
এ কথারও জবাব দিলেন না ইসমত। ইসমত কি এই কথার মানে বুঝতে পেরেছিলেন? কে জানে। তাঁর মুখ দেখেও কিছু বোঝা যাচ্ছিল না।
তাঁর চোখেমুখে তখনো বেদনার ছাপটা লেগেই ছিল।
ওদিকে আমাকে নেওয়ার জন্য সেই তখন থেকে জাদুঘরের দুই কর্মী উশখুশ করছিলেন। ফিরোজ মাহমুদের ইশারা পেয়েই আর দেরি করলেন না। আমাকে মাথায় তুলে হাঁটা দিলেন জাদুঘরের দিকে।
ফিরোজ মাহমুদ বললেন, ‘প্রদর্শনীতে এসো। তোমার নিমন্ত্রণ। এসো কিন্তু!’
বলেই আর অপেক্ষা করলেন না ফিরোজ। চটজলদি বেরিয়ে এলেন ইসমতের ঘর থেকে। তারপর আমাদের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন।
সেদিনই আমি আমি জাদুঘরে এলাম। সেই যে এলাম, এখনো জাদুঘরেই আছি। তবে মাঝে একবার জাদুঘর বদল হয়েছিল। আমিও জাদুঘরের পুরোনো ভবন ছেড়ে নতুন ভবনে আসি। এখন আমি আছি জাতীয় জাদুঘরের ৩৮ নম্বর গ্যালারিতে। আমার একটা রেপ্লিকা আছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাটির তলার জাদুঘরে। দেখতে একেবারে আমার মতো।
আর সেই বিকেলের প্রদর্শনীটা কিন্তু দারুণ জমজমাট ছিল। অনেক বিখ্যাত মানুষ এসেছিলেন। আমাকে দেখার আগ্রহে কত সাধারণ মানুষ যে হাজির হয়েছিলেন! হাজারো মানুষের ভিড়ে সেদিন আমি একটা চেহারা খুঁজছিলাম। ইসমতের চেহারা। যতক্ষণ প্রদর্শনী চলছিল, ততক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। ইসমত আসেননি।
জানি আমাকে দিতে ইসমতের অনেক কষ্ট হয়েছিল। সে কষ্ট তাঁকে অভিমানী করে তুলেছিল। আর সে অভিমান থেকেই সেদিন তিনি আসেননি। 
সবকিছুতে এতটা অভিমান থাকা কি ঠিক?