• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২১, ০১:০৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৬, ২০২১, ০১:০৫ পিএম

হে স্বাধীনতা

হে স্বাধীনতা

ভোর সাড়ে ছটায় ওরা চড়ে বসলো বনগাঁ লোকালে। বেলা এগারোটাতেই ওরা পৌঁছে গেছে। আপ্যায়িত হল গুড়ের নাড়ু,বাতাসা জল সহযোগে। জয় বাংলা স্লোগানে কান প্রায় চৌচির হবার দাখিল। ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে প্রতিবাদে উদ্বেল জনতার দিকে। কমান্ডার সাহেবকে বলতেই তার মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল।

ওরা মানে, মনোজ, রথীন, অশোক আর তপন। বরানগরের নরেন্দ্রনাথ স্কুলের ছাত্র। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে সবে। তাতে কী! বাড়ির বড়দের মুখে তো শুনেইছে। তবে বাংলার মাস্টারমশাই বিমলেন্দু বাবুর কাছে বসে ওরা বারবার যে গল্পটা শুনতো তা বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের। আর স্যারের ফেলে আসা ফরিদপুরের ভিটে মাটি, পুকুর, গোলা ভরা ধান, নীল দিগন্ত বিস্তৃত রুপোলি ধানের ক্ষেত, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি। শুনে শুনেই ওরা কবে যে পুবদিকের ওই মাটি আর মানুষগুলোর প্রেমে পড়ে যায়! পরীক্ষা শেষ। রেজাল্ট বের হয়নি তখনো। শুয়ে বসে তো সবাই কাটাতে পারে না। আর ইতোমধ্যে বাড়িতে আসা যুগান্তর, আনন্দবাজার দেখে দেখে ওদেরও কিছু করার ইচ্ছে খুব। তাই রেডক্রশের যেমন বাক্স হয়, তেমনই বানিয়ে ওরা দাঁড়িয়ে পড়েছিল সিঁথির মোড়ে। দুদিন দাঁড়িয়ে ওরা তুলে ফেলেছে ১০০ টাকা, নিজেদের জমানো আরো ৫০ টাকা। সিঁথি যুবক বৃন্দ ক্লাব দিয়েছে আরো ৫০। সব মিলিয়ে দুশো। কিছু গজ, ব্যান্ডেজ, আয়োডিন বরিক পাউডার তুলো, কিছু চাল ডাল আর একশো টাকা নিয়ে সেদিন ওরা রওয়ানা দিয়েছিল হরিদাসপুর সীমান্তর দিকে। দিনটা ২০ এপ্রিল। আসার আগে রথীনের কাকুর সদ্য জন্মানো সন্তানের ষষ্ঠী পুজোয় রথীন অনুরোধ করেছিল, অবশ্য তা করার আগেই কাকু নিজেই বলেছিল এ সন্তানের নাম হবে মুজিবর। রথীনের ঠাকুমা একটু আপত্তি করলেও তা ধোপে টেঁকেনি। আর টিঁকবেই-বা কেন, সব ঘরে ঘরেই তো তখন সদ্যজাত সন্তানের নাম রাখা হচ্ছে মুজিব। সে যাই হোক আপাতত ওরা এক স্বাধীন রাষ্ট্রের মাটিতে। আর কানে আসতে শুরু করেছে গুলি, মর্টারের আওয়াজ। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। দুজন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বলল আর এগিও না। ক্ষতি হয়ে যেতে পারে৷ আর সন্ধ্যের অন্ধকার নামলে কি ঠিক হবে কেউ জানেও না। একটা গাড়ি আসছিল যশোর থেকে বেনাপোলের দিকেই। কমান্ডার কি যেন বললো, আর ওদের গাড়িতে তুলে দিলো, ওদের এমনিতে ফেরার ইচ্ছেই ছিল না। এতক্ষণে খিদে পাচ্ছে। তবে সব ছাপিয়ে ওদের এক প্রবল উত্তেজনা, ফিরে গিয়ে বন্ধুদের বলবে। এবার সবাই মিলে আসবে। সাথের লিফলেটগুলো যত্ন করে রেখে দেয় ওরা। কমান্ডাররা ওদের ধন্যবাদ জানিয়েছে। আর বলেছে এমন আরো সাহায্য ওদের লাগবে, কারণ সামনে এখন অনেক লড়াই বাকি যে।

২৫মার্চ রাতের অপারেশন সার্চলাইট, প্রায় পঞ্চাশ হাজার নিরীহ মানুষের প্রতিরোধহীন মৃত্যু। ২৬ মার্চে গ্রেপ্তারের ঠিক আগেই, শেখ মুজিবের লুকিয়ে রেখে যাওয়া বার্তা। যা হান্নান বা জিয়াউর রহমান যেই পাঠ করুক, বেতার কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ছে সেই টেলিগ্রাম বার্তা, বাংলাদেশ এক স্বাধীন রাষ্ট্র, যার যা কিছু আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ুন, কারণ খানসেনাকে প্রতিহত করতেই হবে। ইতোমধ্যেই সে বার্তা এসে পৌঁছেছে আনন্দবাজার, যুগান্তরের হাতে। তাদের কাছে অনুরোধ যেন সেই সংবাদ থাকে প্রথম পাতায়। ২৭ মার্চ সকালেই পশ্চিমবাংলার সব বাঙালির ঘরে ঘরে সেই সংবাদ পৌঁছে যাবে। আর আনন্দে শিহরিত হবে বাঙাল নয় ঘটিরাও। বাঘের বাচ্চা মুজিব তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। তাতে কী! স্বাধীনতাকামী মুক্তিসূর্যকে কি আর দাবায়ে রাখা যায়, গেলে তো ১৯৫২তেই যেত। রফিক, বরকতরা যে এমনই। ২৭ মার্চ থেকে আক্রমণ বাড়তে শুরু করলো। এদিকে এই বাংলার বামপন্থী নেতারা ততদিনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে বার্তা দিয়েছেন, যেন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু নেহরুর তো পূর্ববঙ্গের প্রতি সুনজর ছিল না। তার কন্যার কি করেই-বা থাকবে! ইন্দিরা তার নিজের কাজেই ব্যস্ত। দেওয়াল লেখা শুরু হয়েছে, ইয়াহিয়া আর ইন্দিরার কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। তার এদিকে কাতারে কাতারে মানুষ অত্যাচারিত, গৃহহীন মানুষ ঢুকে পড়ছে করিমগঞ্জ, বেনাপোল, গাজোল দিয়ে। তাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে স্কুল বাড়ি। আশপাশের স্থানীয়রা ভাত, রুটি যে যেমন পারছে দিচ্ছে। তাতে কি আর খিদে মেটে! উদ্বাস্তু ত্রাণ শিবির গঠন হয়েছে। মেডিকেল ক্যাম্পও। এপার থেকে ত্রাণ যাচ্ছে ওপারের যুদ্ধে। মানুষ অকাতরে সাহায্য তুলছে, কারণ ওরাও তো বাঙালি। নেহাত ভাগ্যের পরিহাস নইলে, শরৎ বসু-আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দীদের অনুরোধ মানা হতো। হলো কই? ’৪৬-এ চতুর জিন্না চুক্তিপত্রে একটাই মুসলিম রাষ্ট্রের কথা লিখেছেন, ফল ভুগছে এত এত নিরীহ বাংলাদেশি। অন্নদাশঙ্করকে মুজিব বলেছিলেন, ২৩ বছর ধরে বাঙালির জাত্যাভিমানকে পুষে রেখেছি, দিনে-রাতে স্বপ্ন দেখেছি এক স্বাধীন রাষ্ট্রের। সেই স্বাধীনতার ঘোষণা এলো অবশেষে। আর অপেক্ষা অপেক্ষা অপেক্ষা শেষে সেই ’৪৬-এর আফশোস মিটিয়ে দুই বাংলা হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক লড়াইতে। আর মৌলানা ভাসানী, ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দীদের কে ভালো কে মন্দ সে বিচার ব্যতিরেকে শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী বাঙালির একমাত্র আইকন। তার পাশে দাঁড়াবো না? 
ওপরে বলা কথাগুলো রথীন বাবুর। প্রায় সত্তরে পৌঁছনো
প্রৌঢ়র সাথে কথা বলতে বলতে বারবার পৌঁছে যাচ্ছিলাম ’৭১-এর মার্চ-এপ্রিলে। উত্তেজনায় কাঁপছিলাম আমিও। সেদিনের সেই ষোলো বছরের রথীন বাবু বলছিলেন এর কিছুদিন পরেই সার্কাস এভিনিউর পাক হাই কমিশন অফিস হয়ে গেল স্বাধীন বাংলার অফিস। মিশন বাংলাদেশের হয়ে অর্থ সাহায্য তুলছেন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। ওপারে ২৬ মার্চই গঠিত হয়। কিছুদিন পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তৈরি হলো এপারেও। দুই বেতার কেন্দ্র লড়ছে একসাথে। প্রণবেশ সেন, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় যুদ্ধের কথা, ত্রাণ শিবিরের বর্ণনা শুনলে চোখ ভরে যেত জলে। পারতেই হবে শেখ মুজিব, আমরা আপনার পাশে আছি। এরও পর  ইন্দিরা মানেকশার হাতে তুলে দিলেন দায়িত্ব। বাকিটা ইতিহাস।
ফিরে আসার আগে জিজ্ঞেস করছিলাম, পঞ্চাশে পা দেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের কাছে কিছু প্রত্যাশা রাখেন? 
রথীনবাবু হাসছিলেন, স্বাধীনতা আসলেই এক অমোঘ সত্যের নাম। স্বাধীনতার বয়স বাড়লে মাত্রাজ্ঞান লুপ্ত হয়ে তা হয়ে যায় স্বেচ্ছাচারিতা। নিজের সন্তানদের দিয়ে বুঝেছি, এই ভারত দিয়ে প্রতিদিন বুঝি।
শেখ মুজিব এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভাবনার জনক ছিলেন। হয়ত তা সোনার পাথরবাটি। নইলে অত দ্রুত তাকে হত্যা হতে হলো কেন? বাংলাদেশ যেন তার প্রদর্শিত পথেই চলেন। আমরা সাধারণ মানুষ এর বেশি আর কী বলতে পারি...

কলকাতা শহরের প্রাচীন সিঁথি নামক জনপদে হারিয়ে যাওয়ার আগে, আমি বিদায় নিয়ে ফিরছি, চোখে ভাসছে রথীন বাবু, মনে মনে আওড়াচ্ছি : 
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা—
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।

প্রণাম হে স্বাধীন বাংলাদেশ।