• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৪, ২০২১, ০৭:১১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২৪, ২০২১, ০৭:১১ পিএম

জীবনানন্দ সভাঘরে শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল

জীবনানন্দ সভাঘরে শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয়বারের মতো কলকাতায় যাই। প্রথন যখন সুতানুটির কলকাতায় যাই, সেটি ২০০২ সাল। সার্ক রাইটার্স ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে কলকাতায় গেছিলাম। তখন নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয়বার যখন যাই, তখন মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আমার যাওয়ার বিষয় ছিল সিনেমা ‘কাঁটা’-সম্পর্কিত। অবশ্য ঢাকায় থাকতেই ফোনে কথা হয় যশোরে, লেখক বেনজিন খানের সঙ্গে। এ মর্মে কথা হয় যে, জনাব খানের ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। সেই উপলক্ষ কলকাতায় একটি লিটল ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। অনুষ্ঠান হবে আকাদেমির জীবনানন্দ সভাঘরে। বেনজিন ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয় ফোনে, যখন আমি ঢাকায়। আমি বেনজিন ভাইয়ের ৫০ উপলক্ষে মঞ্চে কথা বলব। আরও বলবেন, কবি শঙ্খ ঘোষ। 

শঙ্খ ঘোষের কবিতা বা গদ্যের সঙ্গে আলাপ অনেকদিনের। কখনো দেখা হয়নি। হবে কীভাবে? তিনি থাকেন কলকাতায়, আমি ঢাকায়। বেনজিন ভাইয়ের অর্ধশতক উপলক্ষে দেখা হবে ভেবেই আনন্দ পেলাম। ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ ‘বাবরের প্রার্থনা’ ‘মূর্খ বড়, সামাজিক নয়’ কিংবা ‘ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম’ বা কত লেখাই যে পরেছি। ভালো লাগছিল এই ভেবে যে, তিনি আমাদেরই লোক। দেশভাগ না-হলে সীমান্তের কাঁটাতার থাকত না। বাংলাদেশের চাঁদপুর, বরিশালের বানারীপাড়া বা পাবনার পাকশিতে বাল্যকাল কাটানো বড় কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হবে। কথা হবে। আলাপ হবে। 

নির্ধারিত সেই সভা শুরু হলো জীবনানন্দ সভাঘরে। ছোট্ট মিলনায়তন, কিন্তু দর্শকপূর্ণ। বেনজির ভাইয়ের অর্ধশতক উপলক্ষে তিনি মঞ্চে আছেন, আছেন সেই ‘কুড়ি বছর’ লিটল ম্যাগাজিনের সমাদক, আছেন শঙ্খ ঘোষ এবং আমি। ‘কুড়ি বছর?’  নাকি ‘মধ্যনগর?’

বেনজিন ভাইয়ের কিছু কথা বলেছি মঞ্চে। উনার বাড়ি যশোরে। আমাদের বাড়ি ঝিনাইদহ। আমাদের সরাসরি দেখা হলো কলকাতায়, ২০১৬ সালে। আমাকে সেই মঞ্চে কবিতাও পড়তে হয়। আমি ৩টি কবিতা পড়েছিলাম। সেই তিনটি কবিতা দুপুরে ফেসবুক থেকে দেখে হাতে লিখে এনে দেয় আমার বন্ধু কবি বিভাস রায়চৌধুরী। তিনটি শাদা পৃষ্ঠায় সেই তিনটি কবিতা লেখা। কবিতা আমারই, কিন্তু হাতে লিখে এনে দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছে বন্ধু বিভাস। বিভাস আনন্দবাজারে চাকরি করে। তো মঞ্চে এক পাশে আমি, মাঝখানে শঙ্খ ঘোষ এবং তারপরে বেনজির খান। আমি পকেট থেকে কবিতা বের করলাম, মানে সেই তিন পৃষ্ঠা কাগজ বের করলাম। শঙ্খ ঘোষ তাকিয়ে দেখছেন। আমার পকেট থেকে কবিতার কাগজের সঙ্গে বেরিয়ে এলো কিছু ডলার, কিছু রুপি, কিছু বাংলাদেশি টাকা। শঙ্খ দা বললেন, “তোমার পকেটে এত কিছু?”

শঙ্খ দার উপস্থিতিতে আমি কবিতা পড়লাম জীবনানন্দ সভাঘরে, কলকাতায়। ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট আলাপ চলছিল শঙ্খ দার সঙ্গে। যেমন, সেই সময় সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন লন্ডনে, কর্কট রোগের চিকিৎসায়। আমি শঙ্খ দাকে তার হালনাগাদ জানাতে চাইলে তিনি বললেন, “দুদিন আগেই টেলিফোনে কথা হয়েছে আমার সঙ্গে।”

কথা হলো, তিনি বাংলাদেশে আসবেন, আমরা ঢাকা থেকে একসঙ্গে বরিশালে যাব। বানারীপাড়ায় যাব। কথা ছিল, ভরপুর আড্ডা হবে আমাদের কোনোদিন। আমি তার কাছে শুনব, ত্রিশের দশক-চল্লিশের দশকের তার দেখা বাংলাদেশের গল্প। চাঁদপুরের গল্প। পাকশির গল্প। তার ছোটবেলার গল্প। শুনব, কলকাতায় তাদের পঞ্চাশের দশকের গল্প বা দেশভাগের মধ্যদিয়ে তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়ার গল্প। হয়তো আমিও শোনাব কিছু আমাদের কথা। তবে, শুনব বেশি। কেননা, তিনি একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। তাকে পড়ার আছে অনেক, জানার আছে অনেক।

কিন্তু করোনা ভাইরাসের কাছে তাঁর শরীর পরাজিত হলো। তিনি চলে গেলেন। বাংলা সাহিত্যের বিরাট এক নক্ষত্রের পতন হলো তাঁর প্রস্থানের মধ্য দিয়ে।

আবার এও সত্য, মানুষ মারা যাবেই। এটাই স্বাভাবিকতা। শঙ্খ ঘোষ বা আমরা কেউ-ই এর ঊর্ধ্বে নই। দেশভাগ সংলগ্ন প্রজন্মের একজন শঙ্খ ঘোষ। সেই প্রজন্ম প্রায় বিলীনের পথে। সেদিনের পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগসূত্রিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, বিনয় মজুমদার, ঋত্বিক ঘটক বা যাঁরাই ছিলেন— শঙ্খ ঘোষ তাদের প্রণিধানযোগ্য একজন। চলে গেলেন। আমাদের কেউ চলে গেলেন।

প্রিয় কেউ চলে গেলে কী হয়? শূন্যতায় ভরে যায় ঘর। হাহাকার লাগে। আকাশ আরেকটু নীল হয়। অটোমেটিক আমরা টের পাই, আর দেখা হবে না, শঙ্খ দার সঙ্গে আর কোনোদিন কথা হবে না। 

আজ আকাশটা আরেকটু নীল, ঘরভরতি শূন্যতা ঢেউ...