• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২২, ০১:৪৩ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৬, ২০২২, ০১:৪৩ এএম

জন্মজয়ন্তী

আবেদ খান : সাংবাদিকতায় এক নক্ষত্র

আবেদ খান : সাংবাদিকতায় এক নক্ষত্র

আবেদ খান, বহুমাত্রিক পরিচয়ের অধিকারী। পেশায় আপাদমস্তক সাংবাদিক। মননে সাংবাদিকতার চাষ। স্বপ্নে সাংবাদিকতা-সংশ্লিষ্ট সৃজনের বুনন। তারপর আবার অঙ্গীকারে লেখকও। সাংস্কৃতিক, সামাজিক ক্ষেত্রেও ছড়িয়েছেন আলো। ১৭ বছর বয়সে ১৯৬২ সালে আবেদ খানের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি তৎকালীন বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক ‘জেহাদ’-এ। ১৬ এপ্রিল ১৯৪৫ সালে খুলনা জেলার রসুলপুরে (বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলা) জন্ম আবেদ খানের। তার মাতামহ অবিভক্ত ভারতের দৈনিক আজাদের সম্পাদক মওলানা আকরম খাঁকে বলা হয় এই ভূখণ্ডের সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯৬২ সালে ছাত্রাবস্থায় সাংবাদিকতায় যে আবেদ খানের সংযুক্তি ঘটেছিল, তিনি আজ সাংবাদিকতা জগতে একজন মহীরুহ। তার কর্মময় জীবন বর্ণাঢ্য করে তুলেছেন তিনি তার দূরদর্শী কর্মযজ্ঞে।

১৯৬২ সালে যে সংবাদমাধ্যমে তার প্রকাশ, সেই ক্ষেত্রে তারপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অনেক প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা-আর্থিক অনটনের সীমানা তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে বটে কিন্তু নিজেকে দৃষ্টান্তযোগ্য করে তোলার যুদ্ধে তিনি বিজয়ী। তিনি দেশের সাংবাদিকতায় মুকুটহীন সম্রাট। দৈনিক জেহাদ পত্রিকায় খুব বেশিদিন স্থিত হননি। তারপর অখণ্ড এই ভূখণ্ডে দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক-এ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন ক্রমেই তাকে বিকশিত করে। অনুসন্ধানী অর্থাৎ তদন্তমূলক সাংবাদিকতায় অন্যতম শীর্ষ জন। বলা ভালো, নতুন ধারার জনক আবেদ খান পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পালন করেন সম্পাদকের। ভোরের কাগজ, কালের কণ্ঠ, সমকাল-সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর বর্তমানে দৈনিক জাগরণের প্রকাশক-সম্পাদক হিসেবে পঁচাত্তর ঊর্ধ্ব বয়সেও অক্লান্ত এক স্বপবান যোদ্ধা তিনি। কালের কণ্ঠ পত্রিকাটি তারই জনপ্রিয় কলামের নামে ডিক্লারেশন নেওয়া হয়েছিল। এবং এর তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।

এরই মধ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একুশে টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠালগ্নে সংবাদ ও চলতি তথ্য বিষয়ে প্রধান হিসেবে কাজ করেন। এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কিছুদিন। এর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আবেদ খান ও তার সহধর্মিণী ড. সানজিদা আখতারের যুগল উপস্থাপনায় বিশেষ অনুষ্ঠানগুলো আজও অনেককেই করে স্মৃতিকাতর।  ঘটনার আড়ালে নামক টিভি চ্যানেলেই প্রচারিত তার তদন্তমূলক সাংবাদিকতার অনুষ্ঠানটিও দর্শক মনে গভীরভাবে নাড়া দেয়। এত কিছুর পরও তার অধিকতর আলোকোজ্জ্বল দ্যুতি যেন বেশি ছড়ায় প্রিন্ট মিডিয়ায়ই। তার ওপেন সিক্রেট, অভাজনের নিবেদন, লেট দেয়ার বি লাইট, তৃতীয় নয়ন, টক অব দ্য টাউন, প্রাঙ্গণে-বহিরাঙ্গনে, কালের কণ্ঠ, গৌড়ানন্দ কবি ভনে শুনে পুণ্যবান ইত্যাদি নামে বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত প্রথম পাতায় তাৎক্ষণিক অনুসন্ধানী প্রতিক্রিয়া ও কলামগুলো তুমুল জনপ্রিয়তায় পাঠকের কাছে যেন একসময় হয়ে ওঠে টক অব দ্য কান্ট্রি।

আবেদ খান ভিন্ন মাত্রার একজন সফল সংগঠকও বটে। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে ইউনিয়নে তো বটেই, একাত্তর-পর্বে তার সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকতর উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটে। একাত্তরের ১ মার্চ তিনি পুরান ঢাকার নারিন্দা-ওয়ারী অঞ্চলে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ কমিটির কনভেনর হিসেবে এর স্বাক্ষর রাখেন। ২৫ মার্চ কালরাতে ও দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, ডেইল পিপল ভবন এবং অপারেশন সার্চ লাইটের নামে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার ভয়াবহ অনেক কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী আবেদ খানই প্রথম কলকাতার আকাশবাণী বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ^বাসীর কাছে তুলে ধরেন এই ভূখণ্ডের মর্মন্তুদতা।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবেদ খান দম্পতির খ্যাতি বিপুল। টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘তুমি আর আমি’ ‘একই বৃন্তে’ ‘আনন্দ মেলা’ তাদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। টেলিভিশনে অসংখ্য টকশো সঞ্চালনার মাধমে অর্জিত খ্যাতি তাকে আরও মহিমান্বিত করে এবং তা সমভাবে এখনও প্রবহমান। মুক্ত সাংবাদিকতায়ও তিনি এমন সব উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, যা পরবর্তী প্রজন্মের অনেক সাংবাদিকের কাছেই হয়ে আছে অনুসরণীয় ও অনুশীলনের গুরুত্বপূর্র্ণ পাঠ-অধ্যায়। সাংবাদিক আবেদ খানের প্রকাশিত গ্রন্থ পায় ১৬টি এবং প্রতিটি পাঠকনন্দিত। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে আকাশবাণীতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখা আবেদ খান আট নম্বর সেক্টরে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধকালে।

রাজনীতিতেও তার ছিল দাপুটে পদচারণা। বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ও তখন ১২টি বাম দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় পরিষদের পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার সাংগঠনিক দক্ষতার আরও পরিস্ফুটন ঘটে। নির্মোহ, নীতিনিষ্ঠ, আপসহীন এই ব্যক্তিত্ব চাইলে তো জীবনে আরও কতকিছুই হতে পারতেন। কিন্তু তিনি কখনোই নীতি বিসর্জন দিয়ে নিজের জীবনের জৌলুস বাড়াতে চাননি; যা অনেকেই করেছেন। রেডিও-টেলিভিশনের শিল্পী সংসদের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালেও তার সাংগঠনিক দক্ষতার ভিন্নমাত্রা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

এত অর্জনের পরও তিনি তার কোনো অর্জনই বোঝার মতো বয়ে বেড়ান না। সদালাপী, নির্ভীক এই মানুষটি যে শুধু উচ্চারণেই দৃঢ় তা-ই নয়; তার সারল্য-উদারতার কারণে সুযোগসন্ধানীরা নানাভাবে সুযোগ নেওয়ার পরও মানুষের প্রতি ভালোবাসায় তিনি বড়ই অকৃপণ। দেশের গণমাধ্যম সংস্কৃতিতে সুদীর্ঘকাল তিনি যে অনবদ্য অবদান রেখে আসছেন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, সংস্কৃতি, সামাজিক কর্মকাণ্ডসহ নানাক্ষেত্রে তার রয়েছে অনবদ্য অবদান। তিনি এর স্বীকৃতিস্বরূপ বেসরকারি অনেক সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করলেও রাষ্ট্র তার প্রতি এ ব্যাপারে সুবিচার করেনি। রাষ্ট্রীয় পদক পুরস্কার নিয়ে যখন দফায় দফায় বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তখনও আবেদ খানের মতো ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্র মূল্যায়ন করেনি, যা অত্যন্ত  পরিতাপের।

সাংবাদিকতায় আমার দীক্ষাগুরু-শিক্ষাগুরু তিনি। তাকে আমি একটানা ১৪ বছরের বেশি সময় খুব কাছে থেকে, তার সঙ্গে কাজ করে বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠার মতো পড়ার চেষ্টা করেছি। তাতে সমৃদ্ধও হয়েছি। আমার মনে হয়েছে, তার পুরো দেহটাই হৃৎপিণ্ড এবং তিনি আমাদের সম্পদ। পঁচাত্তরের মর্মন্তুদ অধ্যায়ের হয়তো সৃষ্টি হতো না, যদি তখন আবেদ খানের অনুসন্ধানী বার্তাটি প্রকাশ পেত। ‘ইতিহাসের কাছে আমার দায়’ শিরোনামে একটি দৈনিকে তিনি লিখেছিলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের আগে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তিনি খবরের পেছনের খবর সন্ধান করতে গিয়ে কীভাবে ষড়যন্ত্রকারীদের ডেরায় হাজির হয়েছিলেন এবং ষড়যন্ত্রকারীদের  মুখোশ উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তা-ই উঠে এসেছিল তার লেখা ওই প্রতিবেদনে। কিন্তু তার তখনকার কর্মস্থল দৈনিক ইত্তেফাকে সেই সংবাদটি আলোর মুখ দেখেনি এবং এর পেছনের বিষয়ও অনেকেরই জানা। এসব কারণেই তিনি সাংবাদিকতায় সব্যসাচী। বরেণ্য সাংবাদিক আবেদ খানকে প্রণতি। শুভ জন্মদিন। শুভ কামনা আবেদ ভাই। আপনি প্রজন্মের বাতিঘর।

 

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট  ও কবি।