• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০১৯, ১০:৪০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ৩০, ২০১৯, ১০:৪০ পিএম

শুদ্ধাচার্যদের অশুদ্ধ আচরণ

পরিবর্তনে দরকার যুক্তি ও বিবেকের জাগরণ

পরিবর্তনে দরকার যুক্তি ও বিবেকের জাগরণ
গোলাম মোস্তফা

জামালপুরকে ভিক্ষুকমুক্ত জেলা গড়ার উদ্যোগে ডিসি আহমেদ কবীর ‘শুদ্ধাচার পদক’ লাভ করেন। জামালপুরকে ভিক্ষুকমুক্ত করার চেষ্টা করলেও তিনি নিজেই যে রিপুর ভিক্ষুক, তার প্রমাণ পাওয়া গেল সম্প্রতি ফেসবুকে নারী অফিস সহায়কের সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায়। এ কারণে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। জেলার এ ধরনের কর্মকর্তা হবেন একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব; সবাই তাকে মান্য করবে, তার আদেশ-নির্দেশ মেনে চলবে। এ ধরনের নীতিগর্হিত কর্মকা- তার কাছ থেকে মোটেই আশা করা যায় না। দেশে দুর্নীতির প্রসার, অসৎ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য, নারী ও শিশু নির্যাতনের সহ্যের মাত্রা অতিক্রম করায় এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকার তৈরি করে জাতীয় শুদ্ধাচারের কৌশলপত্র। সরকারের প্রত্যাশা, প্রশাসনের কর্মকর্তারা যদি শুদ্ধাচারের নীতি মেনে চলেন, অন্যকে তা মানাতে অনুপ্রাণিত করেন- তা হলে সমাজের এসব অনাচার-ব্যভিচার এমনিতেই কমে আসবে। মানুষের মনে স্বস্তি বিরাজ করবে। দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে। জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীরও সে শুদ্ধাচারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু সামান্য রিপুর তাড়নার কাছে তিনি হেরে গেলেন। তার সব অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তিনি শুদ্ধাচার পদকের মর্যাদা রক্ষা করতে পারলেন না।

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র তৈরি হয় ২০১২ সালে। সার্বিক বিচারে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাহী বিভাগ ও জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনৈতিক দল, বেসরকারি খাতের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও সুশীল সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকে সমাজের শুদ্ধাচার বাস্তবায়নের জন্য শুদ্ধাচার কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সমাজকে কলুষমুক্ত করতে এবং রাষ্ট্রকে জনকল্যাণমুখী বানাতে সরকারের এ প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, তাদেরও এটা উপলব্ধি করা উচিত-  সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্যই তারা এসব পদে আসীন। সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সাতেই তাদের বেতন-ভাতা হয়, আরাম-আয়াসের ব্যবস্থা করা হয়। এ কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার তাদের স্মরণ করিয়ে দিলেও তারা তাতে কর্ণপাত করেন বলে মনে হয় না।

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মে নিয়োজিত এসব কর্তাব্যক্তিকে সমাজের নৈতিকতা পালনে আমরা আদৌ আগ্রহী হতে দেখি না। সে কারণে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ এবং নারীঘটিত কেলেঙ্কারির ঘটনা অহরহ ঘটেই চলছে। যারা এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, সমাজের দুরাচার প্রতিরোধের হর্তাকর্তা- তারাই আইনকানুন ভঙ্গ করছেন, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন- নিজ লালসাকে চরিতার্থ করে চলেছেন। এ কারণেই ক্ষোভ ঝরতে দেখি সিনিয়র সিটিজেন এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কণ্ঠে। তিনি জীবনের অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান থেকে বেশ কিছু কটু কথা ব্যক্ত করেছিলেন, যা সর্বমহলে তখন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্নীতিতে আমরা সবাই আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সাবেক অর্থমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত দেখা গেছে, তারা সবাই রাষ্ট্রের ওপর মহলের কর্মকর্তা, দ-মু-ের হর্তাকর্তা। 

........................................................................................

‘‘ওসি মোয়াজ্জেমের ধৃষ্টতা, ডিআইজি মিজানের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড, কিংবা ওসি ওসমান গনি পাঠানের ধর্ষণের ঘটনাই শুধু নয়; এ মুহূর্তে ভূমিদখলে সহায়তা করায় ঢাকার ওয়ারী জোনের পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে নিয়ে পুলিশ বিভাগে চলছে তুলকালাম কাণ্ড’’

........................................................................................

সমাজে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটে চললেও দেশবাসীর চোখে তা সহসা দৃষ্টিগোচর হয় না। তাই ডিসি আহমেদ কবীরের পদস্খলন স্বাভাবিকভাবেই আলোড়ন তুলেছে। সমাজে যৌন হয়রানির ঘটনা এখন তো হর্তাকর্তাদের মোয়ামুড়কির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগেও আহমেদ কবীরের মতো এমন অভিযোগে বেশ কয়েক কর্মকর্তা ওএসডি হয়েছেন। বিভাগীয় মামলায় তারা যে খুব বেশি শাস্তি পেয়েছেন, এমন কোনো রেকর্ড নেই। গত বছরের নভেম্বরেই ফেসবুকের মাধ্যমে নাটোরের এক নারী ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে অশোভন আচরণ এবং খারাপ প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ডিসি গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী ওই নারী ম্যাজিস্ট্রেট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করলেও তার কোনো বিচার হয়েছে বলে মনে হয় না।

নৈতিক স্খলনের বিষয়টি ডিসি আহমেদ কবীর বা ডিসি গোলামুর রহমানের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তা না হলে মানুষের সহায়-সম্পদ, মান-মর্যাদা রক্ষার ভার যাদের কাঁধে, সেই পুলিশ কর্মকর্তা ওসি মোয়াজ্জেম এবং ডিআইজি মিজানের বেপরোয়া কর্মকা-ের রেশ কাটতে না কাটতেই, আবার খুলনায় তিন সন্তানের জননীকে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে ওসি ওসমান গনি পাঠানের বিরুদ্ধে। গত ২ আগস্ট মোবাইল চুরির অভিযোগে তাকে আটক করে ওসিসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য ধর্ষণ করে। শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি রাষ্ট্রের এই রক্ষকরা। কী আস্পর্দা এদের- পরদিন ৫ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে ওই ভুক্তভোগী নারীকে কারাগারে পাঠায়! ডিআইজি মিজানের কর্মকা-ে পুলিশ প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ বলে কিছুদিন আগে আদালত পর্যবেক্ষণে অভিমত প্রকাশ করেছিল। কিন্তু ওসি ওসমান গনি পাঠানের পাঁঠার মতো কর্মকা-ে আদালত এখন কী অভিমত প্রকাশ করবে দেশবাসীর সামনে?

ওসি মোয়াজ্জেমের ধৃষ্টতা, ডিআইজি মিজানের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড, কিংবা ওসি ওসমান গনি পাঠানের ধর্ষণের ঘটনাই শুধু নয়; এ মুহূর্তে ভূমিদখলে সহায়তা করায় ঢাকার ওয়ারী জোনের পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে নিয়ে পুলিশ বিভাগে চলছে তুলকালাম কাণ্ড। এ পুলিশ কর্মকর্তা ঘুষের বিনিময়ে পুরান ঢাকার বাড়ি দখলে ভূমিদস্যুদের একের পর এক সাহায্য করে আসছেন বলে পত্রিকায় প্রকাশ। কিছুদিন আগে সিলেটের ডিআইজি (প্রিজন্স) পার্থ গোপাল বণিকের বাসা থেকে হাতেনাতে ঘুষের ৮০ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনায়ও দেশবাসী কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রাষ্ট্রের কর্ণধারদের এ ধরনের কর্মকা- একের পর এক ঘটেই চলেছে।
দেশবাসী কোথায় যাবে, কার কাছে অনিয়ম-অব্যবস্থার প্রতিকার চাইবে? মানুষের শেষ ভরসাস্থল যে বিচারালয়, সেখানেও একই অবস্থা! নিকষ কালো অন্ধকারের বিবমিষা। চারদিকের এসব দেখেশুনে মনে হয়, সমাজের একেবারে মাথায় পচন ধরেছে। মাছ মারা যাওয়ার আগে তার মাথায় পচন ধরে। আমাদের সমাজেরও মাথায় তেমন পচন ধরেছে। নইলে ‘অসদাচরণের’ অভিযোগে তিন বিচারককে বিচারকাজ থেকে অব্যাহতি দিতে হয়! সম্প্রতি ‘অসদাচরণের’ অভিযোগে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি একেএম জহুরুল হক ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হককে বিচারকাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। মানুষের আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল হলো বিচার বিভাগ। সেই বিচার বিভাগের বিচারকদের বিরুদ্ধে এমন যদি ‘অসদাচরণের’ এমন অভিযোগ ওঠে- তা হলে দেশবাসী হাসবে না কাঁদবে তা বুঝতে পারছে না। শোক মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে যা হয়, আমাদের এখন সে দশা। অধিক শোকে পাথর হওয়ার কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দুর্নীতিতে যে ঘুষ নেবে শুধু সেই অপরাধী নয়, যে ঘুষ দেবে সেও অপরাধী হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদের এ অবস্থা থেকে বেরুতেই হবে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এ মুহূর্তে দরকার যুক্তি ও বিবেকবোধের উদ্বোধন। বিবেকবোধই মানুষকে নির্ধারণ করে দেয় কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ। এই ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায় বোঝার ক্ষমতার জন্যই মানুষ আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী। মানুষ নিজে ভালো-মন্দের যুক্তি দেয় এবং অন্যের ন্যায়সঙ্গত যুক্তি মেনে নেয়। এ কারণেই মানুষের সমাজ এগিয়েছে আর পশু সৃষ্টির পর থেকে যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। তাই সমাজকে এগোতে হলে যুক্তি ও বিবেকবোধের স্ফুরণের কোনো বিকল্প নেই। 

লেখক ● সাংবাদিক

আরও পড়ুন