• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০১৯, ০৯:৪৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ৬, ২০১৯, ০৯:৫৪ পিএম

মাদক ছেড়ে ওরা এখন আলোর পথে 

মাদক ছেড়ে ওরা এখন আলোর পথে 

‘দিনে আত্মগোপন, রাতে র‌্যাব-পুলিশের ভয়ে নির্ঘুম কাটানো। সেই সঙ্গে মরণঘাতী মাদকের ভয়াবহ ছোবল। প্রতিটি মুহূর্ত যেন ভয় আর উৎকণ্ঠায় কাটছিল। এর মধ্যেও মাসে মাসে মামলার ঘানি টানতে আদালতে কাঠগড়ায়। কখনোবা স্বজনদের ছেড়ে জেলখানার চার দেয়ালে বন্দি।’

‘সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছিল অভিশপ্ত জীবন। ভেবেছিলাম আর বোধ হয় বাঁচা হবে না। কিন্তু না, খুঁজে পেয়েছি আলোর দেখা। মা-ভাই এবং স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বেশ ভালোই কাটছে জীবন সংসার। দেখছি সৎ পথে বড় হওয়ার স্বপ্ন। মানুষের কাছ থেকে পাচ্ছি আত্মসম্মানও।’

অনেকটা আবেগ জড়ানো কণ্ঠে কথাগুলো বলেছেন বরিশালের উজিরপুর পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের টেম্পু স্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা পিতৃহারা ২৬ বছর বয়সী যুবক মো. গোলাম রাব্বি বালি। তিনি বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজির আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাদকের অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আত্মসমর্পণ করে আলোর পথে ফিরেছেন।

একান্ত আলাপে মাদক ব্যবসা ছেড়ে সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা রাব্বি বালি বলেন, ‘মাত্র ১৮ বছর বয়সে বাবা মারা যান। অসহায় মায়ের পক্ষে সংসারের জোয়াল ধরা সম্ভব হচ্ছিলো না। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে আমাকে এবং ছোট ভাই ও বোনের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিয়েছেন। মায়ের কষ্ট দেখে নিজেই উপার্জনের পথ খুঁজি। কিন্তু নিষ্ঠুর এ জগতে কেউ কাউকে সহযোগিতার হাত বাড়ায় না। আমার ভাগ্যেও তেমনটিই ঘটেছিল।’

রাব্বি বলেন, ‘বেকারত্ব জীবন নিয়ে কয়েকটি বছর কেটে যায়। এর মধ্যে সাড়ে তিন বছর আগে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করেছি। বিয়ের পরে সংসারে জোয়াল কাঁধে ওঠে। দেখা দেয় চরম অর্থসংকট। কোনো কাজ না পেয়ে অর্থের জোগান দিতেই বেছে নিয়েছিলাম অন্ধকার মাদকের জগৎ। প্রথমে মাদক সেবন করেছি। এর পর প্রতিবেশী মাদক ব্যবসায়ী মামুন হাওলাদারের মাধ্যমে সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ি।’

‘আমার মূল ব্যবসা ছিল ইয়াবা এবং ফেন্সিডিল। যা পেতাম প্রতিবেশী মামুনের কাছ থেকেই। প্রথম প্রথম এগুলো বিক্রি করে বেশ ভালই আয় রোজগার হতে লাগলো। এক পর্যায়ে পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী হয়ে গেলাম। টাকার দেখা মিললেও অসৎ পথে এ আয়ে সংসারে শান্তি এলো না। বরং অশান্তি যেন চিরসঙ্গী হয়ে গেল। মাদকসহ ধরা পড়ে হয়ে গেলাম তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ী। পর পর হওয়া দুটি মাদক মামলায় আদালতে হাজিরা এবং মামলা চালাতে গিয়ে যা উপার্জন করেছিলাম এর সবটুকুই ফুরিয়ে গেছে। এর উপর র‌্যাব-পুলিশের অভিযানের ভয়ে কত রাত যে নির্ঘুম কেটেছে তা গুনে বলা যাবে না। দিনের আলোয় ভয় কম থাকলেও সমাজে মিশতে পারতাম না। ঘৃণা আর আড়চোখে দেখত সবাই। মা, ছোট ভাই-বোন এবং স্ত্রী- কারোর কাছে মুখ দেখাতে পারতাম না। কেউ মিশতো না আমাদের সঙ্গে। জন্ম নেয়া আমাদের শিশু সন্তানের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। তাই ভেবেছিলাম এ অপরাধের জগৎ ছেড়ে ভালো হয়ে যাব। কিন্তু সেই সুযোগ পাচ্ছিলাম না।’

রাব্বি বলেন, ‘হঠাৎ করে গত প্রায় দুই বছর আগে উজিরপুর থানার ওসি স্যার আমাকে ধরে নিয়ে বলল মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে এবং ডিআইজি স্যারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। সুযোগটা আর হাতছাড়া করলাম না। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। সকলের সামনে আত্মসমর্পণ করলাম। আর কখনো মাদকের সংস্পর্শে যাব না বলে প্রতিজ্ঞা করলাম। ডিআইজি এবং এসপি স্যার খুশি হয়ে আমার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলেন।’

‘সৎপথে রোজগারের জন্য তিন চাকার একটি ভ্যানগাড়ি উপহার দিলেন। ওই ভ্যান গাড়ি চালিয়ে মা-স্ত্রী-সন্তান এবং ভাই-বোনদের কষ্ট করে দিন চলছিল। এরপর মা রাশিদা বেগম গত প্রায় দুই বছর আগে প্রবাসে যান। মায়ের দেয়া টাকায় একটি গ্যাসচালিত অটো টেম্পু কিনেছি। আমি নিজেই অটো টেম্পু চালাচ্ছি এবং ডিআইজি স্যারের দেয়া ভ্যানগাড়িটি ভাড়া দিয়েছি। প্রতিদিন সেখান থেকে ৩০ টাকা করে পাচ্ছি।’

‘আত্মসমর্পণের পরে একটি মামলা থেকে খালাসও পেয়েছি। আরেকটি মামলা রয়েছে, সেটিও ডিআইজি স্যার লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে পরিচালনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে আমি এবং আমরা এখন বেশ ভালোই আছি। আসলে মাদক কোনো ভালো জীবন নয়। এটি একটি অভিশপ্ত জীবন। আমি ফিরে এসেছি। এখনো যারা এই অভিশপ্ত জীবনে রয়েছেন আমি মনে করি তাদেরও ফিরে আসা উচিত।’

একইভাবে কথা হয় মাদক ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসা ঝালকাঠি সদর উপজেলার কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা মাদক ব্যবসায়ী রুবিনা বেগম (৩০) এর সঙ্গে। তিনি জানান, ‘স্বামী মনিরুজ্জামানের মাধ্যমে মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। গাঁজা এবং ইয়াবা বিক্রি করতাম। শুধু বিক্রিই নয়, একসময় মাদকাসক্তও হয়ে পড়ি। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৪টি মাদক মামলা হয়েছে। এর দুটিতে আমিও আসামি।’

তিনি বলেন, ‘মাদকের কারণে সংসারে সীমাহীন অশান্তি ছিল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মারপিট, কলহ লেগেই ছিল। প্রতি রাতে পুলিশ এসে দরজার কড়া নাড়ত। ঘরে বিয়ের যোগ্য কলেজপড়ুয়া মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা চলে এলো। পরে ডিআইজি স্যারের ডাকে সাড়া দিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনই মাদক ব্যবসা ছেড়ে আত্মসমর্পণ করেছি। স্যার আমাদের একটি সেলাই মেশিন দিয়েছেন। কিন্তু মেশিন চালানোর জন্য যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন সেটা না থাকায় মেশিন বিক্রি করে দিয়েছি। স্বামী এখন কাঠমিস্ত্রির কাজ করছেন। ঝালকাঠির এসপি স্যার বলেছেন স্বামীকে যুব উন্নয়নের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেবেন।’

‘সব থেকে বড় কথা হল পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এখন আর আমাদের খোঁজ করছে না। হয়রানি করছে না। কেউ চাঁদা চাইতে আসছে না। বরং একজন দারোগা (এসআই) সবসময় আমাদের খোঁজ-খবর রাখছেন। দুঃখ-কষ্ট থাকলে তা সমাধানের চেষ্টা করছেন। তাই আমরা এখন ভালো আছি।’

মাদক ছেড়ে শান্তিতে জীবন-যাপনের গল্প বলেছেন, উজিরপুরের গুঠিয়ার আ. হালিম ও ইউনুস হাওলাদার। তাদের একজন মাদক ও গাঁজা ব্যবসায়ী এবং অপরজন গাঁজা সেবনকারী। আত্মসমর্পণের পরে এদের দুজনকেই কর্মস্থানের জন্য দুটি সেলাই মেশিন উপহার দেয়া হয়েছে ডিআইজি ও এসপি অফিস থেকে। এরা দুজনই সেলাই মেশিন ভাড়া দিয়ে একজন চা-পানের ব্যবসা এবং অপরজন মাহেন্দ্র (টেম্পু) চালিয়ে সৎপথে উপার্জন করছেন।

মাদক ছেড়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসা বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের লোহালিয়া গ্রামের শ্যামল সেনের ছেলে প্রদীপ শীল (২৫) জানান, ‘বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। পরে বাবুগঞ্জের ওসি স্যার বললেন আত্মসমর্পণ করার জন্য। তার কথামতো আত্মসমর্পণ করেছি। পরে ডিআইজি স্যারের ব্যবস্থাপনায় আমাকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সেখান থেকে ফিরে এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ।’

তিনি বলেন, ‘স্যার আমাকে একটি সেলাই মেশিন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি আনিনি। কারণ আমার কর্মসংস্থান রয়েছে। বাবুগঞ্জ বাজারে আমার প্রদীপ হেয়ার কাটিং নামক সেলুন রয়েছে। তা দিয়েই আমার জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে।’

বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান ডিআইজি (উপ-মহাপরিদর্শক) শফিকুল ইসলাম ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট বরিশালে যোগদান করেন। এর পরপরই বরিশাল বিভাগকে মাদকমুক্ত করতে নানা উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে মাদক ব্যবসায়ী এবং সেবনকারীদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়ার বিষয়টি অন্যতম। এমনকী এতে বেশ সফলতা এবং প্রশংসাও কুড়িয়েছেন তিনি।

ডিআইজির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বরিশাল রেঞ্জের ৬টি জেলার ১ হাজার ৬৩ জন মাদক ব্যবসায়ী এবং সেবনকারী মাদকের অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আলোর পথে নতুন জীবনে ফিরেছেন। এর মধ্যে ৩৪৩ জনক মাদকসেবীকে চিকিৎসার জন্য বিনামূল্যে এবং স্বল্পমূল্যে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসা শেষে নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন ৩০৮ জন মাদকসেবী। এখনো চিকিৎসাধীন ৩৫ জন।

আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে ৩৯০ জনকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের পছন্দ অনুযায়ী কাউকে চায়ের দোকানের সরঞ্জামাদি, কাউকে রিক্সা-ভ্যান, মাছ ধরার জাল এবং সেলাই মেশিন দেয়া হয়েছে। ২৮১ জনের মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদকসেবীকে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি পুনর্বাসনমূলক কর্মসূচি ও রেজিস্টার্ড সমবায় সমিতি গঠন করে দিয়েছেন ডিআইজি।

.....................

.....................

 

৬টি জেলার ১ হাজার ৬৩ জন মাদক ব্যবসায়ী এবং সেবনকারী মাদকের অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আলোর পথে নতুন জীবনে ফিরে গেছেন। এর মধ্যে ৩৪৩ জনক মাদকসেবীকে চিকিৎসার জন্য নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়। চিকিৎসা শেষে ফিরে গেছেন ৩০৮ জন মাদকসেবী। চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩৫ জন 

ঝালকাঠি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমএম মাহমুদ হাসান বলেন, ‘ডিআইজি স্যারের দিকনির্দেশনায় মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমপর্ণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যারা স্বেচ্ছায় মাদকের জগৎ ছেড়ে দিচ্ছে তাদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যারা আত্মসমর্পণ করছে না তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শফিকুল ইসলাম বিপিএম (বার), পিপিএম বলেন, ‘পুলিশের কাজ হলো আইন প্রয়োগ করা। কিন্তু আইন প্রয়োগেই সব সমস্যার সমাধান নয়। একজন মাদক সেবনকারীর বিরুদ্ধে যখন মামলা হচ্ছে তখন ওই মামলা চালাতে গিয়ে তাকে আরও অপরাধ করতে হচ্ছে। মামলার খরচ বহন করতে গিয়ে সে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়। এতে দেখা যায় একজন মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকায় সে আর ভালো হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এ কারণেই মাদক ব্যবসায়ী এবং সেবনকারীদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যারা মাদক ছেড়ে আলোর পথে এসেছে তাদের পুলিশ বা কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এখন আর বিরক্ত করছে না। তারা শান্তিতে বসবাস করছে। যারা আত্মসমর্পণ করেনি তাদের গ্রেফতারসহ মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হচ্ছে। আবার যারা আত্মসমর্পণ করে পুনরায় মাদকের জগতে ফিরে গেছে তাদের বিরুদ্ধেও পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। আমরা চাই না কারোর বিরুদ্ধে মামলা হোক, আর সেই মামলা চালাতে গিয়ে বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ুক। তাই যারা এখনো আত্মসমর্পণ করেনি তাদের জন্য আমাদের দরজা খোলা আছে। চাইলে তারাও আত্মসমর্পণ করে আলোর পথে ফিরে আসুক। এতে অন্যদের মতো তারাও ভালো থাকবেন।’

এফসি

আরও পড়ুন