• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২১, ১০:৪৬ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ১০, ২০২১, ১১:২৫ এএম

সিনেমার আলাপ

১৯৮৪: চিত্ত ও চিন্তার মুক্তি যেখানে অপরাধ

১৯৮৪: চিত্ত ও চিন্তার মুক্তি যেখানে অপরাধ

যখন কোন রাষ্ট্র ডানদিকে সরতে সরতে সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী হয়ে ওঠে, কিংবা বামদিকে যেতে যেতে একনায়কতান্ত্রিক চরিত্র অর্জন করে, তখন জনগণের অবস্থা কোথায় দাঁড়ায়, তারই বস্তুনিষ্ঠ উদাহরণ মাইকেল র‍্যাডফোর্ড পরিচালিত ‘১৯৮৪’ (১৯৮৫)ছবিটি, সকলেরই জানা এটি বানানো হয়েছে জর্জ ওরওয়েলের একই নামের বিখ্যাত উপন্যাস থেকে। চলচ্চিত্র আলোচনায় প্রবেশের আগে উপন্যাসটি লেখার প্রেক্ষাপট জেনে নিলে পাঠিকার সুবিধাই হবে বৈকি।

ওরওয়েলের এই উপন্যাসকে আদতে কল্পবিজ্ঞান বলা যায় কি না তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, তবে তিনি সদ্য শেষ হওয়া দুই নম্বর বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের ভেতর বসে যা দেখেছেন তাই লিখেছেন, রূপকের আশ্রয় নিয়ে। তাই এটিকে রূপকাশ্রয়ী উপন্যাস বলা যেতে পারে। ১৯৪৯ সালে বইটি যখন প্রকাশ হয়, ততদিনে যুদ্ধ থেমেছে, কিন্তু ক্ষত রেখে গেছে গোটা ইউরোপে। ওরওয়েল যখন উপন্যাসটি লিখছেন তখন মিত্রশক্তি ইউরোপকে পূব ও পশ্চিমে ভাগ করছে, উইন্সটন চার্চিল যাকে বলছেন লৌহপর্দা টেনে দেয়া। যুদ্ধের শেষলগ্নে সোভিয়েত ইউনিয়ন কবজা করে নিচ্ছে হাঙ্গেরি ও চেকোস্লোভাকিয়া। জোর প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে রাশিয়াও পাল্লা দিয়ে পারমানবিক বোমা তৈরি করছে। অন্যদিকে, জাপানে পারমানবিক বোমা ফেলে নিজের শক্তি জাহির করার পর, ইউরোপে বাণিজ্য বিস্তারে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করছে মার্শাল প্ল্যান। দুনিয়া দুই পরাশক্তিতে বিভক্ত। ঠান্ডাযুদ্ধের কাল শুরু। একদিকে চরম ডানপন্থী, অন্যদিকে চরম বামপন্থী। এমনই এক প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের ভয়াবহতাকে পেছনে রেখে ওরওয়েল লিখলেন নজরবন্দী অমানবিক পরিবেশে বাঁচার আকুতির গল্প।

বিগ ব্রাদারের রক্ত চাহনি

র‍্যাডফোর্ডের ছবিতেও উপন্যাসের আবহ ফুটে উঠেছে—ওসেনিয়ার শহরে কোথাও আলো ঝলমল করে না, বিষণ্ণ আকাশ, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, পলেস্তারা খসে পড়া দেয়াল, চাবি দেয়া পুতুলের মতো মানুষ আর দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা মিথ্যা মন্ত্রণা ও চোখ রাঙানি। ছবির মূল দুই চরিত্র উইন্সটন স্মিথ (জন হার্ট) ও জুলিয়া (সুজানা হ্যামিলটন) যে মাঝে শহর থেকে দূরে, রৌদ্রজ্জ্বল দিনে সবুজের মাঝে সঙ্গমে নিজেদের স্বাধীনতা চুরি করে নেয়, সেটাই ওসেনিয়ার মানুষের মনে পুষে রাখা তীব্র আকাঙ্ক্ষা, ওটাই পরবর্তী সময়ে পরাধীন বাস্তবতায় তুরীয় সুখ আকারে স্মিথের কল্পনায় হাজিরা দেয় বারবার। আরেকটি মূল চরিত্র অবশ্য আছে, গোটা ছবিতে যার অস্তিত্ব আছে, আবার নেই, সে হলো অগ্রজভ্রাতা বা বিগ ব্রাদার, রহস্যময় নেতা। যার রক্তচক্ষু সবসময়, সবজায়গায়, নজরদারি করছে ক্লান্তিহীন। মানুষ যেখানে কফি, চকোলেট বা রেজার ব্লেডের মতো সাধারণ জিনিস পায় না, কোনরকমে দুবেলা খেয়ে বেঁচে থাকে, সেখানে শয়নকক্ষেও বড়ভাইয়ের চোখ সজাগ দৃষ্টি রাখে। কে কার সাথে শুলো, কে বিপ্লবী মনোভাব পোষণ করল, কে সকাল সকাল উঠে শরীরচর্চা করল না ইত্যাদি।

বড়ভাই চান না কেউ প্রেমটেম করুক, সংসারী হোক, তিনি চান না লোকে সত্য জানুক, তিনি চান না পার্টির তরফ থেকে বর্ষিত সাহিত্যের বাইরে কেউ কিছু পড়ুক। তিনি চান নিঃশর্ত, নিষ্কাম, নিরুপায় ব্যক্তির সম্পূর্ণ সমর্পন। তার ব্যত্যয় ঘটলেই তাকে ধরে নিয়ে যায় ‘চিন্তা পুলিশ’ এবং অভিযুক্ত করা হয় ‘চিন্তা অপরাধী’ হিসেবে। বড়ভাইয়ের কাছে মুক্তচিন্তা করাটাই বিশাল অপরাধ। মুক্তচিন্তার লোকেদের ধরার জন্য আবার বড়ভাই কৌশলী ফাঁদ পেতে রেখেছেন। যার অসহায় শিকার হয় আমাদের স্মিথ। ব্লেড কিনতে সে যে দোকানে যায়, সেখানকার দোকানী তার কাছে বিক্রি করে সাদাপাতার খেরোখাতা। সেটাই ছিল পাতা ফাঁদের প্রথম ধাপ। স্মিথ নিজের ছোট এক কামড়ার বাসায়, ইটের ফাঁকে লুকিয়ে রাখে সেই খাতা। বড়ভাই যে দেয়াল থেকে স্ক্রিনের মাধ্যমে তাকিয়ে থাকে, তারই একপাশে, নজর এড়িয়ে স্মিথ নিজের মনের ভাবনাগুলোকে মুক্ত করতে থাকে এই খাতার পাতায় পাতায়। বড়ভাইয়ের কাছে এটা বিশাল চিন্তা-অপরাধ। কিন্তু স্মিথ আর দশটা মানুষের মতো নয়, সে লিখে উঠতে থাকে—বেঁচে থাকা নয়, মানবিকভাবে বেঁচে থাকাটা জরুরি। বড়ভাই যে অমানবিক সেটা এই চিন্তায় প্রকাশিত। স্মিথের মতো করে ভাবতে পারাটাই ওসেনিয়ার সমাজে বিপ্লবী কাজ। আর বড়ভাই বিপ্লব সহ্য করবে কেন?

শুধু লিখে গেলেও চলতো, বড়ভাইয়ের আরেক নাপছন্দ কাজ নারী-পুরুষের মিলন— যা মানবসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং মানবজাতির টিকে থাকার নিশ্চয়তা দান করে—ঘটিয়ে ফেলে স্মিথ ও জুলিয়া। দুজন মিলে পরিবার গড়ে তুললে মানুষ আর একা থাকে না, যূথবদ্ধ হয়ে যায়, এটা বড়ভাইয়ের পছন্দ হবে কেন? সে চায় মানুষ বিচ্ছিন্ন থাকুক, একা থাকলে মানুষ অসহায় থাকে, এতে তার সুবিধা। স্মিথ আর জুলিয়া যখন খাতা বিক্রেতার সৌজন্যে এক গোপন কুঠুরীতে ধোয়া ওঠা কফিতে প্রেম ও দ্রোহের মন্ত্র উচ্চারণ করছে, ঠিক তখন নগ্ন অবস্থায় তাদের গ্রেপ্তার করে চিন্তা-পুলিশ। সভ্য দুনিয়ায় মানুষ যেখানেসেখানে বিবস্ত্র হয় না। বিবস্ত্র হওয়া মানে সে তার ভেতরটা তুলে ধরে, খুলে দেয় সকল দুয়ার, ঠিক সে সময় ভয়ংকর পোশাক পরিহিত অস্ত্রধারীরা যখন ঘিরে ফেলে, তখন সবচেয়ে অপ্রস্তুত ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে অসহায়বোধ করে মানুষ। এরপর জুলিয়ার ভাগ্যে কি ঘটে তা জানা যায় না, কিন্তু স্মিথের উপর চলে অবর্ণনীয় অত্যাচার।

শহর থেকে পালিয়ে স্মিথ ও জুলিয়া

স্মিথ সরকারের সত্য-মন্ত্রণালয়ের এক সাধারণ কর্মচারী ছিলো। পার্টির জন্য যা অপ্রয়োজনীয়, হুমকিস্বরূপ সেসব খবর পুড়িয়ে ফেলা এবং সংশ্লিষ্টদের নাম-পরিচয় মুছে ফেলাই ছিলো তার কাজ। মোদ্দা কথা সত্যকে উধাও করে দেয়া। এই সত্য-মন্ত্রণালয় থেকেই বের করা হয় ‘নয়াবলা’ বা নিউস্পিক অভিধান। সেখানেও চলে সত্যের অপলাপচর্চা। সত্য-মন্ত্রণালয় যে ইতিহাস রচনা করে, তা সঠিক নয়, স্মিথ তা অনুধাবন করতে পারে। পার্টি মনে করে বর্তমান যার হাতে সেই অতীত নিয়ন্ত্রণ করে, অতীত যার হাতে ভবিষ্যৎও তার নির্মিত। এভাবেই নিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে অবিরত মিথ্যার জন্ম দেয় পার্টি। স্মিথ এর থেকে নিস্তার চায়। চিন্তাকে সে মুক্ত করে খাতার পাতায়, আর সবুজ ঘাসের উপর জুলিয়ার প্রেমে মুগ্ধ স্মিথ মুক্ত করে চিত্তকে। চিন্তা ও চিত্তকে মুক্ত করার অপরাধেই আটক করা হয় স্মিথকে, নেয়া হয় ভালোবাসা-মন্ত্রণালয়ে। আহা ভালোবাসা!শাসকগোষ্ঠী বরাবরই বলে থাকে আইন জনসাধারণের তরে, বাস্তবে তা ঐ আমজনতার বিপক্ষেই যায়।

স্মিথ গোপনে গোপনে যে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চাইছিল তা টের পেয়ে যায় পার্টির ভেতরকার এক নেতা ও’ব্রায়ান (রিচার্ড বার্টন)। সে-ই অফিসে ডেকে স্মিথকে নয়াবলা অভিধানের নতুন সংস্করণ উপহার দেয়, যার ভেতর লুকানো থাকে ওসেনিয়ার সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক ইম্মানুয়েল গোল্ডস্টেইনের নিষিদ্ধ রাজনৈতিক পুস্তক: দ্য থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস অব অলিগারকিক্যাল কালেক্টিভিজম। গোষ্ঠীবদ্ধ মুষ্টিমেয় স্বার্থপর ও দুর্নীতিবাজ মানুষ কি করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে তার উপর এই কিতাব রচিত। স্মিথ ভেবেছিল ও’ব্রায়ান তলকুঠুরির গোপন দলের সেনাপতি, তাকে সে সেপাই করতে চায়। স্মিথ বই পড়তে পড়তে বুঝতে পারে এই পার্টি যুদ্ধকে শান্তি, স্বাধীনতাকে ভৃত্যগিরি আর অজ্ঞতাকে শক্তি বানিয়ে টিকে আছে। সমাজকে একতাবদ্ধ রাখতে রাষ্ট্র খেলে যাচ্ছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, কখনো ইউরেশিয়ার সাথে, কখনো ইস্টেশিয়ার সাথে। গ্রন্থপাঠে স্মিথ আরো জানতে পারে দারিদ্র ও অজ্ঞতার উপর ভর করেই সমাজে শ্রেণীবিভাজন হয়। স্মিথের ভাবনা যখন পার্টির বিপরীতে স্বচ্ছ হয়ে উঠতে থাকে, ঠিক তখনই আবিষ্কার হয় সেই খাতা বিক্রেতা আর ও’ব্রায়ানের আসল চেহারা। তারাই আসলে অসুস্থ ভুবনে ফাঁদ পেতে রেখেছিল। স্মিথের মতো লেখক-ভাবুক-প্রেমিকদের ধরার জন্যই তাদের সেই ফাঁদ।

১০১ নম্বর নির্যাতন কক্ষে যখন স্মিথকে অংক শেখানোর চেষ্টা করে ও’ব্রায়ান, তখন স্মিথ বারবারই তার অচেতন চলে যেতে থাকে সেই প্রকৃতির সঙ্গে মিলনের স্থানে। কিন্তু সেখানেও এক পর্যায়ে হানা দেয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য ও’ব্রায়ান। স্মিথের অচেতনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় পার্টিবেরাদার। সে স্মিথকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিতে চায় দুই যোগ দুই চার নয়, তিন কিংবা পাঁচও হতে পারে। জীবন সরল অংক দিয়ে চলে না। কিন্তু স্মিথ তো তার খাতায় লিখেছিল, স্বাধীনতা মানে স্বাধীনতা, এর একচুল কমও নয়, বেশিও নয়। দুই যোগ দুই মানে চার। অংকের এই প্রমাণিত সূত্র পাল্টে দিতে চায় পার্টি। যেভাবে তারা মুছে ফেলতে চায় মানুষের অতীত। নির্যাতনের ভেতরেই স্মিথ বলতে থাকে অতীত মুছে ফেলা যায় না, কারণ মানুষের স্মৃতি লুপ্ত করা সম্ভব নয়, তাকে নিয়ন্ত্রণও করা যায় না। ও’ব্রায়ান প্রত্যুত্তরে বলে, স্মিথ নিজের স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে বলেই আজ  সে এখানে। মনের শৃঙ্খলাভঙ্গ হয়েছে বলেই স্মিথ নিজেকে আর সমর্পিত করে রাখতে পারেনি পার্টির কাছে। তারই সাজা ভোগ করতে হচ্ছে তাকে। এমন করে স্মিথ আর ও’ব্রায়ানের মধ্যে চলতে থাকে স্বাধীনতা, স্মৃতি, ত্রিকাল আর সত্য-মিথ্যা নিয়ে দার্শনিক বাহাস। শেষ পর্যন্ত নানা ধরনের অত্যাচারের ভেতর দিয়ে শেষ হয় ১০১ নম্বর ঘরের কার্যক্রম।

১৯৮৪ কোনো ভবিষদ্বাণী নয়, সতর্কবাণী

যৌক্তিক উত্তর দেয়া বন্ধ করে দেয় স্মিথ। আপাতদৃষ্টিতে পার্টির পুতুলে পরিণত হয় সে, কিন্তু বড়ভাইয়ের তৈরি করা ভীতিকর প্রাসাদের কার্নিশে এক টুকরো আশাও ঝুলে থাকে: আমরা দেখি স্মিথ দাবার বোর্ডের সামনে ধুলো পড়া জায়গায় লিখছে ‘২+২=’, যোগফলের জায়গায় সে আর কিছু লেখে না। এরপর দাবার গুটি ঘোড়াকে সে ধরে, যার চাল ‘আড়াই ঘর’, তাকে ধরেও আবার রেখে দেয়। ভুল যোগফল, ভুল চাল দেয়ার চেয়ে চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করে স্মিথ। বড়ভাইয়ের চোখরাঙানির উল্টোদিকে ফিরে অশ্রুসজল চোখে স্মিথ মনে মনে বলে ওঠে: তোমাকে ভালোবাসি। এখানেই আশা বসত পাতে। বিশাল আয়োজন করে, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে, পুলিশি রাষ্ট্র বানিয়ে, নজরদারি বাড়িয়ে, ফাঁদ পেতে, অত্যাচার করে লেখক-ভাবুক-প্রেমিকের মুখের জবান হয় তো বন্ধ করে দেয়া যায়, কিন্তু তার চিন্তাকে কখনোই হত্যা করা যায় না। ঘৃণা, জোরজবরদস্তি,অত্যাচার,শাসন ও শোষণের বিপরীতে ভালোবাসাই টিকে থাকে মৌনমিনার হয়ে।

     

আরও পড়ুন