• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০১৯, ০৫:১০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ১, ২০১৯, ০৫:২১ পিএম

নদীয়ায় তুর্কি বিজয় ও বাংলা ভাষার মুক্তি

নদীয়ায় তুর্কি বিজয় ও বাংলা ভাষার মুক্তি

নদীয়াসহ বঙ্গাঞ্চলের শাসক যখন উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শ্রেণি শাসন করছে, তখন এ অঞ্চলে একচেটিয়ে সংস্কৃত ভাষা আর ব্রাহ্মণ শ্রেণির হাতে থেকেছে শিক্ষা-সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক দায়ভার। কিন্তু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শাসক শ্রেণি শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতি দেবালয়ের বাইরে আনেনি এবং জনসাধারণের ত্রিসীমায় পৌঁছাতেও দেয়নি। সুতরাং শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতি সে পর্যন্ত না আলোর মুখ দেখলো, যে পর্যন্ত না বর্হিভারতের শাসক এ অঞ্চলে শাসন শুরু করলো।

নদীয়ায় তুর্কি আক্রমণ ও বিজয় থেকে শুরু করে দীর্ঘকাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী শাসনকালের উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ সমাজ নতুন শাসন ও স্থায়ী জনসাধারণের সামাজিক মর্যাদা মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে, এ সময়ে স্থানীয় লোকভাষা-লোকসাংস্কৃতি-লোকসাহিত্যের ব্যপক প্রচার ও প্রসার করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলে। অপরদিকে, সংস্কৃত পণ্ডিত সমাজ সাহিত্য-সংস্কৃতিতে স্থান করে নেয় না; ব্রাহ্মণের আভিজাত্যে তারা নতুন শাসন ব্যবস্থা থেকে দূরে থাকে বা তারা তুর্কি শাসকদের অনুকূলেও আসতে পারে না বা দুইচার ঘর ব্রাহ্মণ যারা সেন দরবারে ছিলেন, তারা ভয়ে শাসকদের কাছে ঘেঁষেনি বা দেশান্তরিত। সুতরাং গা বাঁচাতে বা নতুন শাসন ব্যবস্থায় নিজেদের মানিয়ে নিতে ব্রাহ্মণদের অনেক দিন সময় লেগেছে। যেমন দেখা যায়, ইংরেজ শাসন আমলে ইসলামিপন্থি শিক্ষিতদের অবস্থান।

নদীয়ায় তুর্কি বিজয়ের পর দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হলো- আমাদের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ আর ‘রামায়ণ’ এর অনুবাদ পেতে। যে রামায়ণের কথা- কাহিনি মাতৃভাষায় শুনলেও কৌরব নরকে যাবার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু এই তুর্কি বিজয় থেকে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে লোক দ্বারা যা রচিত হলো- তা, ‘শূন্যপূরাণ’ ‘প্রাকৃত পিঙ্গল’ ‘সেক শোভদয়া’ এ সব কাব্যগুলো ব্রাহ্মণ সমাজ এখনো মেনে নিতে পারছেন না। এ কাব্যগুলো রচিত হওয়ার সময়টারে ব্রাহ্মণ পন্ডিত সমাজ অন্ধকারে রেখে সময়টারে ‘অন্ধকার’ যুগ বলে প্রচার করলেন।
কিন্তু আমরা দেখি, ব্রাহ্মণ্যবাদের সময় যখন সংস্কৃত ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা অন্যায় ছিলো, তখন লোকজীবনে গৃহআশ্রমে ঝি-কন্যা, মায়ের মুখে ছিলো লোকদেবতার জয়গাথা ব্রত-পাঁচালী কাহিনি।

রামাই পন্ডিত যখন শূন্যপুরাণে ‘বখতিয়ার খিলজি’কে ‘নিরঞ্জনের’ মর্যাদা দিলেন এবং সনাতনী  ধারায় একব্রহ্মা (বম্ভা) থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং সেই ব্রহ্মাই ফিরে এলেন ‘বঙ্গবাসীকে’ উদ্ধার করতে; তখন আর কোনো সংশয় থাকে না যে, তুর্কি বিজয়ে নদীয়া বা ‘বঙ্গে’ কোনো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছিলো। তাছাড়া আমরা আর একটি দিকে দৃষ্টি দিলেও দেখবো যে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা পতনের সময়েও শাসক আর জনগণের কোনো যোগ ছিল না। সেন-তুর্কি সময়ে তা আশা করাই যায় না। ‘অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, এই কালে যখন সাধারণ মানুষের মনে শান্তি-স্বস্তির অভাব ছিল, তখন স্বভাবতই কেহ সাহিত্য রচনার প্রতি বিশেষ আগ্রহবোধ করেননি। 

আগেই বলা হয়েছে, তখনকার দিনে রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয়েছে। সাধারণ মানুষের তাতে কোনো আগ্রহ, উৎসাহ বা স্থান ছিলো না। সুতরাং তুর্কি বিজয়ের ফলে সাধারণ মানুষের মনে বিশেষ কোনো প্রভাব-পড়েনি বলে বুঝা যায়। যখন সাধারণেরা বুঝলো ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যুগ শেষ এবং সংস্কৃত ভাষা নয়, তারা তাদের নিজ নিজ ভাষায় জ্ঞান-সাধন আর সাহিত্য-সাধন করতে পারবে; এমকি নিজ নিজ দেবতার জয়গাথাও করতে পারবে, তখন তারা মহাউৎসাহে মঙ্গল কাব্য রচনায় ব্রতী হন। রামাই পন্ডিত তাঁদের অগ্রগণ্য। এ সময়- সেনদের মুখামেক্ষী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা শান্তি-স্বস্তির অভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের মনে রাখতে হয় যে, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা সাধারণ জনসাধারণ ছিলেন না। এমনকি রাজনৈতিক কারণে তাঁরা হয়তো দেশান্তরিত ছিলো। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ছিলো ব্রাহ্মণদের হাতে; মাধ্যম ছিলো সংস্কৃত ভাষা। ফলে, প্রচলিত অন্ধকার যুগের ধারণা ভুল বলেই এখন আমাদের বিশ্বাস।

তুর্কি বিজয় থেকে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন পর্যন্ত সময়ে রচিত সাহিত্যকে উচ্চমর্যাদা দেয়া যদি নাও হয়, তবুও বলতে হবে এ সময়টাই বাঙালি আর বাংলা ভাষার মুক্তির কাল। ‘আমরা এই ১২০১ হইতে ১৩৫২ খ্রী. অ. পর্যন্ত সময়কে বাঙ্গালা সাহিত্যের মধ্যযুগের অন্ধকার বা সন্ধিযুগ বলতে পারি।’  বলে যে প্রচালত মতামত রয়েছে, তা শুরুতে গবেষক নিজেই দিধায় ভোগেছেন, আসলে কী হবে ভেবে। কারণ, ‘অন্ধকার’ আর ‘সন্ধিযুগ’ এক বিষয় হতেই পারে না। যা অন্ধকার, তা ‘সন্ধি’ হতে পারে না।


সংস্কৃত ভাষা দেবালয়ে ফিরে গেলো; জ্ঞানচর্চা আর সাহিত্যে শুরু হলো- বাংলা ভাষা আলোড়ন। বাংলা ভাষার আলোর যাত্রী হয়ে এলো তুর্কি শাসন। যে কারণে ড. সুকুমার সেন বাংলা ভাষার সূচনা কাল নির্ণয় করেছেন এই তুর্কি শাসন থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ। এ সময় থেকে তিনি চর্যার গীতিগুলো ও সূচনা ধরেছেন। আসলে, চর্যাগীতির কবিদের জীবন অস্পষ্ট এবং তারা গোপন সাধন সাধনা করতেন। ভয় পেতেন বৌদ্ধ শাসকদের ফলে লোক ভাষায় লোকায়িত  দর্শন প্রকাশ প্রচার তাদের দ্বারা সেন আমলেও সম্ভব হয়নি।

তারও উদাহরণ চর্যাগানে এবং গানের গীতিকারদের সামান্য জীবনীতেই দেখা যায়। সোমপুর বিহার ত্যাগে বাধ্য হলেন কাহ্নপা এ যুক্তির উদাহরণ। এ আলোচনায় আমরা এটুকু বলতে পারি যে, চর্যার গানগুলো যখন থেকেই শুরু হোক, তখন থেকে বাংলা ভাষার (সমসাময়িক বাংলার নিকটবর্তী সকল ভাষা) সূচনা এবং তুর্কি বিজয়ের ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ ভাষার মুক্তি।

লেখক : ইতিহাস গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বিক

আরও পড়ুন