• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০১৯, ০৬:৫৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ২২, ২০১৯, ০৮:২৪ পিএম

ভারতের এনআরসির বিষয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরল বিএনপি

ভারতের এনআরসির বিষয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরল বিএনপি
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর - ছবি : জাগরণ

ভারতের আইনসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করা ও এর পেছনে বাংলাদেশ এবং বিএনপিকে জড়িয়ে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ ও ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রাবীশ কুমারের বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি।

রোববার (২২ ডিসেম্বর) বিকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ‘ভারতের এনআরসি’ বিষয়ে বিএনপির সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বক্তব্যের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হকের ওপর হামলার নিন্দা জানান মির্জা ফখরুল।

মির্জা ফখরুল বলেন, বিজেপি সরকার হিন্দুত্ববাদী ভারত প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও বিএনপির কাঁধে বন্দুক রেখে মিথ্যাচারের মাধ্যমে সম্পূর্ণ শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে এ অঞ্চলের রাজনীতিকে একটি অসুস্থ পরিবেশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। 

তিনি বলেন, অমিত শাহ এবং রাবীশ কুমার উভয়ের বক্তব্যই  অসত্য, অপব্যাখ্যামূলক, একপাক্ষিক, বৈষম্যমূলক, বিভ্রান্তিকর এবং চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের বক্তব্য আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করছি।

ফখরুল বলেন, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের পক্ষে যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে গিয়ে অযাচিতভাবে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে এনেছে। তিনি ঢালাওভাবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে একই ‘বন্ধনীতে’ চিহ্নিত করে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম হওয়ার কারণেই বাংলাদেশে অন্য ধর্মের মানুষরা নিপীড়িত হচ্ছেন।

তিনি বলেন, কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এখন এক ‘সোনালী অধ্যায়ের’ মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, দুদেশের নেতারা প্রায়ই এমন দাবি করে থাকেন। অথচ অমিত শাহ বলছেন, সেই বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশেই হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টানরা এখনও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অমিত শাহ পার্লামেন্টে তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের নাম উচ্চারণ করে শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে সরাসরি অভিযুক্ত করে বলেন, বাংলাদেশে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাবস্থায় সেখানে ব্যাপকহারে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে। নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ভারতে পালিয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিএনপিকে সাম্প্রদায়িক নিপীড়নকারী দল হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন।  

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বিএনপি সরকারের আমলে বরাবরই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ ছিলো। বাবরী মসজিদ সংকট এবং গুজরাট-দাঙ্গার সময়ও খালেদা জিয়ার আমলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল। বিএনপির সব আমলেই তার সরকার  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখতে সফল হয়েছে।

তিনি বলেন, নাগরিক সংশোধনী আইন(CAA)কে অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক, অসাংবিধানিক ও মানবতাবিরোধী আখ্যায়িত করে সারা ভারতে এখন প্রতিবাদ চলছে। শুধু সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে টার্গেট করেই এ আইন প্রণীত হয়েছে বলে আজ জনমনে বিশ্বাস স্থাপিত হয়েছে। এমনকি ভারতের অমুসলিম সম্প্রদায়ের বিবেকবান মানুষও এই বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করছে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণের এই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী সমালোচিত ও নিন্দিত হচ্ছে। জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক দেশ ও বিবেকবান জাতিগোষ্ঠী এহেন বৈষম্যমূলক আইনের কারণে চরমভাবে উৎকণ্ঠিত। এরই মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক মিশন (ইউএসসিআইআরএফ)  মার্কিন প্রশাসনকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করার সুপারিশ জানিয়েছে। 

আন্তর্জাতিক এই প্রতিক্রিয়ায় প্রমাণিত হয়, এই অসন্তোষ শুধু ভারতের সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ক্রমান্বয়ে তা গোটা উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করবে। চরমভাবে আঘাত করবে এই অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় জনগণের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা এবং ঐতিহ্যকে। যার সুদূরপ্রসারী কুপ্রভাবের শিকার হতে হবে  জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে।

মির্জা ফখরুল বলেন, সম্প্রতি ভারতের আসামের ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের নাম জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। যা উত্তর-পূর্ব-ভারতীয় বিভিন্ন রাজ্যসহ বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের মাঝে ব্যাপক উৎকন্ঠার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবাংলায় এনআরসির মাধ্যমে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে নাগরিকহীন করার ঘোষণা ভারতের ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও বিজেপির কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতৃত্বের তরফ থকে লাগাতারভাবে প্রচার ও প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। পশ্চিমবাংলাসহ ভারতের অন্যান্য রাজ্যে বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবেই সাম্প্রতিক নাগরিক সংশোধনী (CAA) আইনটি সংসদে পাস করা হয়েছে বলে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ঘোষণা দিয়েছে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিএনপি বিভিন্ন সময়ে সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এনআরসি বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরা ঢালাওভাবে এনআরসি সমস্যাকে স্রেফ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন এবং এখনও যাচ্ছেন।

আশঙ্কা প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, মিয়ানমার যেমন রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গাদের ‘স্টেটলেস’ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে, একইভাবে নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি জটিলতায় সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলিমদের ‘স্টেললেস’  ঘোষণা করে জোর করে বাংলাদেশে পুশ-ইন করার প্রক্রিয়া লক্ষ্য করছি। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এনআরসির কারণে বাদপড়া নিরীহ ভারতীয় নাগরিকদের ‘উইপোকা’ আখ্যায়িত করে প্রত্যেককে ভারত থেকে বের করে দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। আসামের গোয়ালপাড়ায় এরই মধ্যেই ‘ডিটেনশনসেন্টার’ নির্মাণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এনআরসি উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার তাদের ব্যর্থ পররাষ্টনীতির প্রমাণ হিসেবে যেভাবে নির্বিকার রয়েছে, তা স্পষ্টতই আমাদের জনগণ, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান।

দুই দেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ ও বিএনপি সম্পর্কে ভারতীয় পার্লামেন্টে যে অসত্য বক্তব্য দেয়া হয়েছে, ভারত সরকার তা অবিলম্বে  প্রত্যাহার করে নিবে এবং ভবিষ্যত পারস্পারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার লক্ষ্যে এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রদানে বিরত থাকবে বলে বিএনপির প্রত্যাশার কথা প্রকাশ করেন মির্জা ফখরুল। 

টিএস/এসএমএম

আরও পড়ুন